আমীন আল রশীদ
কোনো একটি যৌক্তিক দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে যখন বিশেষ কোনো রাজনৈতিক
দলের প্ররোচনা কিংবা অমুক দলের ইন্ধনে এটি হচ্ছে বলে খোদ সরকারের তরফে অভিযাগ করা হয়,
তখন ধরে নিতে হবে, সেই দাবিটি যতই জনগুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তার ফলাফল শূন্য।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভিসির বাসভবনে ভাঙচুরের সমালোচনা করে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী
হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলছে, চলবে। এই রাজাকারের
বাচ্চাদের অবশ্যই আমরা দেখে নেব।’ কৃষিমন্ত্রীর
অভিযোগ, কোটা সংস্কারের নামে সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্যকর
পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। এরা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের
উত্তরসূরি।
যদিও ভিসির বাসভবনে হামলার দায় অস্বীকার করেছেন আন্দোলনকারীরা।তাহলে
প্রশ্ন ওঠে, কারা এই হামলা চালালো। এটি যে যথেষ্ট পরিকল্পিত সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণের
সুযোগ নেই। তার মানে প্রস্তুতিটা আগে থেকেই ছিল। যদি কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যই সঠিক হয়
যে, ভিসির বাসভবনে প্রকৃত শিক্ষার্থীরা হামলা চালায়নি, তাহলে ধরে নিতে হবে, এই আন্দোলনের
স্রোত অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্যই ভিসির বাসায় মধ্যরাতে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে
এবং সেখানে তৃতীয় কেউ অবশ্যই জড়িত।
তবে ভিসির বাসায় কারা হামলা চালিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও স্বার্থ
কী, তা নিয়ে তর্ক করে কোটা সংস্কারের দাবিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বা এই দাবিকে
পাশ কাটিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই।
কোটা সংস্কার ইস্যুতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনকে শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের
চেতনাপরিপন্থি বলে প্রচার চালাচ্ছে একটি পক্ষ। তারা মনে করে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান
ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বাতিল করাই আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য। বাস্তবতা হলো,একটির
সঙ্গে আরেকটি গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। সবকিছু এত সরলভাবে বিশ্লেষণও ন্যায্য নয়। বিশ্বের
কোন দেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা আছে? এখানে মুক্তিযোদ্ধা, নারী কিংবা উপজাতি
কোনো বিষয় নয়। এই বিশাল কোটার কারণে মেধাবী ও যোগ্যদের একটি বড় অংশই যে সরকারি চাকরির
বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না, এই আন্দোলনের মূল স্পিরিট সেটিই এবং এই দাবির পক্ষে আমার
মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিই শুধু নয়, খোদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদেরও
সমর্থন আছে। ফেসবুকে এরইমধ্যে আমরা একাধিক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানকে লিখতে দেখেছি
যে, ‘আমরা কোটা চাই
না।’
কিন্তু তারপরও এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী করা
যায়:
১. যেহেতু এই আন্দোলনের পেছনে বিএনপি-জামাতের উসকানি বা সমর্থন আছে বলে
প্রচার চালানো হচ্ছে, তাই চিহ্নিত হবার ভয়ে অনেকেই এই আন্দোলনে যুক্ত হবেন না, এমনকি
এ বিষয়ে কিছু লেখার আগেও দশবার ভাববেন। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, কোটা সংস্কারের পক্ষে বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা শিক্ষকদের স্ট্যাটাসের নিচেও যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে
এই আন্দোলন ঘিরে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার নামে আরেকটা সাইবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কাও
উড়িয়ে দেয়া যায় না।
২. আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, বিশেষ করে ভিসির বাসভবনে ন্যক্কারজনক হামলাটি
যদি সত্যিই প্রকৃত আন্দোলনকারীরা না করে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এটি হয় তৃতীয় পক্ষ,
যারা এই আন্দোলনটিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ
দিতে চায় তাদের কাজ অথবা যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন নস্যাৎ করতে চায়, তাদের
স্যাবোটাজ। যেটিই হোক, শুধু এই ভিসির বাসভবনে হামলার জের ধরেই আন্দোলনটি স্তিমিত করে
দেয়া হবে। কারণ ভিসি বলেছেন তিনি আইনি পদক্ষেপ নেবেন। এরইমধ্যে শতাধিক শিক্ষার্থীকে
আটক করার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। তবে পুলিশ বলছে, উপাচার্যের বাসায় হামলায় জড়িত হিসেবে
যাদের শনাক্ত করা হবে, তাদের ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
৩. রোববার রাতের সংঘর্ষে আহত অনেককে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু গণমাধ্যমের খবর বলছে, তাদের অনেকেই ‘অজ্ঞাত’ বা ‘অজানা’ নাম দিয়ে জরুরি
বিভাগের টিকিট কেটেছেন। প্রশ্ন হলো, কেন তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করছেন? পুলিশি হয়রানির
হাত থেকে বাঁচতে নাকি মতিয়া চৌধুরীর আশঙ্কাই সত্যি? সত্য নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে।
৪.যেহেতু সরকারের পরিস্কার অবস্থান কোটার পক্ষে এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও
বিভিন্ন সময়ে কোটা রাখার পক্ষে যুক্তি ও মত
দিয়েছেন, সে হিসেবে সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের আলোচনা যাই হোক, শেষমেষ খুব
ইতিবাচক কিছু আসার সম্ভাবনা কম। অনেককেই হয়তো ভয়-ভীতি দেখিয়ে চুপ করে রাখা হবে। এভাবে
ধীরে ধীরে আন্দোলনটি তার শক্তি ক্ষয় করবে এবং আর দশটা ইস্যুর মতো এটিও চাপা পড়ে যাবে।
৫. সচিবালয়ে সরকারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর এক মাসের জন্য আন্দোলন
স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হলেও একটি পক্ষ তা মানছে না। বরং তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার
ঘোষণা দিয়েছে। তার মানে নিজেদের মধ্যেই দুটি ভাগ হয়ে গেলো। কোনো আন্দোলন নস্যাৎ করার
জন্য সেখানে নিজেদের মধ্যে এরকম ‘কেলো’ বাঁধিয়ে দেয়াই
যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে সতর্ক করেছিলেন, ‘মনে রাখবেন শত্রুপক্ষ
ঢুকে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টির চেষ্টা করবে।’ যুগে যুগে সব
আন্দোলন সংগ্রামেই এরকম শত্রুপক্ষ ঢুকে পড়ে এবং বিভেদ সৃষ্টি করে আন্দোলন বানচালের
চেষ্টা করে।
৬. কোটা সংস্কার দাবির এই আন্দোলন নিয়ে যাতে বিভ্রান্তি ও বিভেদ সৃষ্টি
না হয়, সেজন্য তাদের মিছিলে ‘জয়বাংলা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার
বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নেই’ ইত্যাদি শ্লোগানও দেয়া হয়েছে। কিন্তু
দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলকারীদের ওপর শুধু পুলিশ নয়, বরং ছাত্রলীগও হামলা
চালিয়েছে। অথচ এই আন্দোলনে ছাত্রলীগের অনেকেই যুক্ত। শুধু এই আন্দোলন নয়, বাংলাদেশের
সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগেই ছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু কোটা সংস্কার ইস্যুতে তাদের
একটি বড় অংশের ভূমিকাই বিপরীত এবং সম্ভবত এটি এ কারণে যে, সরকারের আপাতত অবস্থান কোটার
পক্ষে। তবে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের
হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন পদধারী
তিন জন নেতা। সোমবার (৯ এপ্রিল)এ ঘোষণা দেন তারা। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন তারা।
৭. মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা
কোটা সংস্কার বা ৩০ শতাংশ থেকে এটি কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা বেশ কঠিন। আবার নারীদের
জন্য বরাদ্দ ১০ ভাগ কোটা বাতিল করলে তারও প্রতিক্রিয়া হবে।তাছাড়া কোনো একটি কোটা বাতিল
বা কমানো হলে অন্যগুলোও বাতিল বা কমানোর দাবি উঠবে। ফলে যেহেতু কোটা একবার চালু হয়ে
গেছে, তাই এটি বাতিল বা সংস্কার যেকোনো সরকারের জন্যই চ্যালেঞ্জিং।
সবকিছু বিশ্লেষণ করে এটা বলা যায় যে, কোটা সংস্কার দাবিতে গড়ে ওঠা এই
ন্যায্য, যুক্তিসঙ্গত এবং সময়োপযোগী আন্দোলনের ভেতরে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে। তারা আন্দোলনকে
ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে নিজেদের অন্য স্বার্থ অর্জন করতে চায়।আবার সরকারও যেহেতু চায়
এই আন্দোলন থেমে যাক, ফলে ওই তৃতীয় পক্ষের কর্মকাণ্ডকেও প্রকৃত শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে
চাপিয়ে পুরো আন্দোলনটি শেষ করে দেয়া অসম্ভব নয়। যদি তাই হয়, তাহলে রাজপথে একটি ন্যায্য
দাবির অকালমৃত্যু ঘটবে এবং যে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা আমাদের স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্রে ছিল, সেরকম একটি সাম্য ও মানবিক মর্যামদার রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া আরও
পিছিয়ে যাবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।
##

No comments:
Post a Comment