Monday, March 19, 2018

বনলতা সেন: অমীমাংসিত তর্ক



আমীন আল রশীদ
বনলতা সেনকে নিয়ে বাহাসের প্রসঙ্গ এলে আরেকজনের নাম মনে রাখা প্রয়োজন––তিনি সুধীরকুমার। জীবনানন্দের বন্ধু। মৃত্যু ১৯৩৫, যে বছর কবিতা পত্রিকায় বনলতা সেন প্রকাশিত হয়েছিল। বন্ধুর অকালমৃত্যু তাঁকে ব্যথিত করে। যাঁকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন: মুখে তার পাখির নীড়ের মতো আশ্বাস ও আশ্রয়ের হাসি তবে সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে আমরা একটু দেখে নেয়ার চেষ্টা করি, বনলতা সেনকে নিয়ে বা তাঁর পরিচয় নিয়ে কেন বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে এমন বিশ্লেষণ ও আলোচনা।

বনলতা সেনের সাকিন তিনি লিখেছেন নাটোর। বাংলাদেশের উত্তরের একটি মফস্বল শহর। এটি খুলনাও হতে পারতো। বরিশাল তো বটেই। আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল বরিশালের বনলতা সেন অথবা পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে খুলনার বনলতা সেন’––তাতে ছন্দ ও বিষয়ের ইতরবিশেষ হত না। কিন্তু তিনি লিখেছেন নাটোর; জীবনানন্দের পারিবারিক বন্ধনের সাথে যে শহরটি কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। তার নিজের জন্ম বরিশালে, বেড়ে উঠেছেন এই শহরেই। এরপর কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। তাঁর দাদাঠাকুর সর্বানন্দ দাশ মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে বরিশালে এসে বসতি গড়েন। ঢাকার সাথেও তাদের সামান্য যোগাযোগ ছিল বৈকি। আর বরিশাল থেকে জীবনানন্দ মূলত স্টিমারে খুলনায় এবং সেখান থেকে কলকাতায় যেতেন। তার মামাবাড়িও বরিশালের একটি গ্রাম কলসকাঠিতে।

ফলে কোনো সমীকরণেই নাটোরে তার যাওয়া বা অবস্থানের প্রমাণ মেলে না। কিন্তু তারপরও এই শব্দটির একটা আলাদা তাৎপর্য নিশ্চয়ই রয়েছে। মলয় রায়চৌধুরী তাঁর পোস্টমডার্ন জীবনানন্দ নামে ৪২ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে চরিত্রগুলির নামকরণে লেখকের অভিপ্রায় গবেষকরা খতিয়ে দেখতে পারেন। মাল্যবান নামটি পুরান থেকে নেয়া। বাঙালি পরিবারে এই নামের প্রচল আছে বলে মনে হয় না। পুরানে চরিত্রটি প্রান্তিকবর্গের। মাল্যবান হলেন রাক্ষসরাজ সুকেশের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম। তার জন্ম গন্ধর্বকন্যা দেহবতীর গর্ভে। মাল্যবানের স্ত্রী অতিব সুন্দরী। অনলা নামে তার একটি মেয়ে। মাল্যবান স্বর্গের দেবতাদের আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু হেরে গিয়ে পাতালে আশ্রয় নেন

ফলে বনলতা সেন নামে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জীবনানন্দের মনের ভেতরে আসলেই কে ছিলেন, তার সুরাহা করা কঠিন। তবে সেই বিতর্কে না গিয়ে আমরা বরং আলোচনাটিকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাই।


.
বনলতা সেন সম্ভবত বাংলা ভাষার একমাত্র কবিতা, যাকে নিয়ে দশকের পর দশক ধরে আলোচনা ও বিশ্লেষণ অব্যাহত। কবিতা ভালোবাসেন কিন্তু বনলতা সেন পড়েননি বা এই কবিতার প্রেমে পড়েননি, এমন লোক একজনও খুঁজে পাওয়া কঠিন।

আমরা রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের, আধুনিককালের শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, সৈয়দ হক, নির্মলেন্দু গুণ কিংবা আরও পরে হেলাল হাফিজেরও এমন কোনো কবিতার কথা উল্লেখ করতে পারব না, যা নিয়ে এত উন্মাদনা। তাদের অনেক কবিতাই হয়তো শত সহস্রবার পঠিত হয়েছে; কিন্তু বনলতা সেনের মতো এত আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক হয়নি। কিন্তু কেন? এর কারণ সম্ভবত একটি লাইন: থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন এই অন্ধকার এবং মুখোমুখি শব্দ দুটির ভেতরেই সমস্ত রহস্য। অন্ধকারে কে কার মুখোমুখি বসে থাকে? এখানে কবির সাথে মুখোমুখি বসে থাকা মানুষটি কে? সে কি আদৌ মানুষ নাকি সে বস্তুত সময়? কিন্তু যে ব্যাকুল প্রতিক্ষার কথা আমরা এই কবিতায় পড়ি, যেভাবে সিংহল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির কাছে কবির ফিরে আসা এবং যাকে দেখে বনলতা সেন বলছেন, এতদিন কোথায় ছিলেন’––অর্থাৎ বনলতা সেন নিজেও যার জন্য ব্যাকুল, তিনি কে

আমরা এখানে আরেকটা বিষয় খেয়াল করব, জীবনানন্দের কবিতার অন্য নারীরা যেমন, সুচেতনা বা সুরঞ্জনার সঙ্গে বনলতার একটা বড় পার্থক্য আছে। তা হলো––এখানে বনলতাকে তিনি আরও বেশি সুনির্দিষ্ট করার জন্য সেন পদবি যুক্ত করেছেন। অর্থাৎ এখানে শুধু বনলতা থাকলে যতটা না, সেন যুক্ত হবার ফলে সেটি অধিকতর রক্তমাংসের মানুষে পরিণত হয়েছে। এরকম আরেকটি নাম আমরা তার কবিতায় পাই, তিনি অরুনিমা স্যানাল।
সমস্যা অন্য জায়গায়, জীবনান্দকে দেখে বনলতা সেন বিস্ময়ে, আনন্দে এবং সম্ভবত শিহরণে জিজ্ঞেস করছেন: এতদিন কোথায় ছিলেন? অর্থাৎ আপনি বলে সম্বোধন করছেন। যার জন্য এত প্রতিক্ষা, তাকে কেন তুমি বলে সম্বোধন নয়? এটি কি কেবলই পরের লাইনের সাথে অন্তমিল রাখার জন্যই?
বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নিড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

যদিও জীবনানন্দ তাকে সে বলেই সম্বোধন করছেন। এখানে জীবনানন্দের সাথে বনলতার সম্পর্কটা আসলে কী? . আকবর আলি খানের ভাষায় বনলতা কি আসলেই একজন বারবণিতা?


.
বনলতা সেনের সঙ্গে নাটোরের সম্পর্ক খোঁজা অন্যায্য কিছু নয়। নাটোরবাসী এ ভেবে পুলকিত হতেই পারেন যে, বাংলা ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁদের শহরের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতায়। অথবা এই কবিতাটির কারণেই নাটোর বিখ্যাত হয়েছে। জীবনানন্দ এবং বনলতা সেনের প্রতি এই শহরের মানুষের যে কী আবেগ তার প্রকাশ ঘটে এখানে বনলতা বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই শহরে বনলতাকে নিয়ে আরও অনেক উদ্যোগ ছিল বা এখনও আছে। 

কিন্তু বনলতা সেন নামে নাটোরের কোনো নারীর সঙ্গে জীবনানন্দের আদৌ পরিচয় ছিল কি না, থাকলেও তাঁর সাথে নাটোরেই পরিচয় কি না কিংবা তিনি আদৌ নাটোরে গিয়েছিলেন কি না––তা নিয়ে জীবনানন্দের মৃত্যুর ছয় দশক পরেও যে তর্ক আর গবেষণা চলছে, তাতে এটিই প্রমাণিত যে, বনলতা এক চিররহস্যের নাম।

আমরা সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সুদর্শনা, শ্যামলি, শঙ্খমালা, সবিতা কিংবা অরুনিমা স্যানালের নাম জানলেও জীবনানন্দের এই নারীদের বিষয়ে আমাদের বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। তাঁদের ঠিকুজি অণ্বেষনে ব্যপ্ত নই। কিন্তু বনলতার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের মূল কারণ তাঁর বাড়ির ঠিকানা এবং সেন পদবি যুক্ত করে জীবনদাশ তাঁকে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবার প্রয়াস পেয়েছেন। 

শিল্পীর ম্যাজিক এখানেই। আমরা লাতিন সাহিত্যে যেমন গার্সিয়া মার্কেজ কিংবা আমাদের শহীদুল জহিরে এই ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতার সন্ধান পাই, জীবনানন্দ দাশ সেই কাজ বহু আগেই করে গেছেন:
‘‘নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরে জানলার থেকে
গান গায় আধো জেগে ইহুদি রমণী;
পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান––
আর কাকে বলে সোনা, তেল, কাগজের খনি।’’

সুতরাং বনলতা সেন নামে রক্তমাংসের কোনো মানবীর অস্তিত্ব থাকতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাঁর বাড়ি নাটোরেই হতে হবে, এমনও নয়। বরং প্রথম পর্বেই বলেছি যে, তাঁর বাড়ি বরিশাল কিংবা খুলনায়ও হতে পারতো। হতে পারতো কলকাতার হ্যারিসন রোডে। তখন আমরাও তাঁকে খুঁজতে খুলনায়, বরিশালে, কিংবা হ্যারিসন রোডে যেতাম। অথচ তিনি হয়তো কোনোদিন জন্মগ্রহণই করেননি। অথবা হয়তো জন্ম নেবেন কোনো একদিন। এবং তাঁর সাক্ষাৎ পেলে নিশ্চয়ই আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করব: ভোলাভালা জীবনানন্দের সঙ্গে তিনি অন্ধকারে মুখোমুখে কী করেছিলেন!

মি. খান (আকবর আলি খান) এই অন্ধকারে মুখোমুখি বসে থাকার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং বনলতাকে নাটোরে গিয়েই আবিষ্কার করেছেন,সেদিকে নিশ্চয়ই আমাদের আলোকপাত করতে হবে। কিন্তু তার আগে আমাদের সুধীরকুমারকে নিয়ে একটা মীমাংসায় পৌঁছানো জরুরি। কেননা আমাদের মনে হবে যে, এই সুধীরকুমারই বস্তুত বনলতা সেন। 

.
আমার সহকর্মী শাহরিয়ার শিশির। অফিসের সামনের ফুটপাথে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে একদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বনলতা সেন আসলে কে? আমি তাকে বলেছিলাম, আপনিই বনলতা সেন। অথবা আমি। কিংবা আমরা। শিশির বিস্মিত হন। 

তাকে খেয়াল করতে বলি এই লাইনটির দিকে: আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন এখানে দুদণ্ড শান্তি শব্দযুগল খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানে হলো, আমরা যার কাছ থেকে দুদণ্ড শান্তি পাই, তিনিই বনলতা সেন। এই যে আপনি আমার সাথে এক কাপ চা খেতে খেতে বনলতা সেন নিয়ে আলোচনা করছেন এবং আমি খেয়াল করছি যে, আপনার ভেতরে একটা প্রশান্তির ছায়াতার মানে হলো এখানে আমিই বনলতা সেন।

আপনি যদি আপনার প্রিয়তমার কাছে গিয়ে দুদণ্ড শান্তি পান, তাহলে তিনিই বনলতা সেন। আপনি যদি আপনার মায়ের সাথে গল্প করে দুদণ্ড শান্তি পান, তাহলে আপনার মা-ই বনলতা সেন। বনলতা সেন এখানে ইউনিভার্সাল। একটা প্রতীক। নারী-পুরুষের জেন্ডার বা সেক্সের বহু ঊর্ধ্বে। এখানে বনলতা সেন বস্তুত প্রশান্তির অন্য নাম।
একটা বিশুদ্ধ চাকরির জন্য জীবনান্দকে সারা জীবন কী ভীষণ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে, তা সবার জানা। আজ  এ কলেজ তো কাল ও কলেজ এমনকি বিমা কোম্পানির দালালি। এতকিছুর মধ্যেও ১৯২৯-৩০ সালে দিল্লির রামযশ কলেজে শিক্ষকতার সময়টুকু তিনি ওই অর্থে উপভোগ করেননি। ক্লিনটন বি সিলি  (অনন্য জীবনানন্দ পৃষ্ঠা ১৪২) লিখছেন, বরিশালে তাঁর সতীর্থ ব্রাহ্ম ও বছরখানেকের ছোট সুধীরকুমার দত্ত তাঁকে কিছুটা সাহচর্যু দিয়েছিলেন। তাঁরা ঘন ঘন পরস্পর দেখা করতেন। জীবনানন্দ যখন দিল্লি আসেন, তখন সুধীরকুমার তার সঙ্গে রেলস্টেশনে দেখা করেন। প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় পর জীবনানন্দ সেই উপলক্ষ্যে সুধীরকুমার সম্পর্কে লেখেন: মুখে তার পাখির নীড়ের মতো আশ্বাস ও আশ্রয়ের হাসি। বনলতা সেন কবিতার ক্লান্ত পথচারীর দিকে চোখ তুলে সেই একই আশ্রয়ের স্বস্তি ও আশ্বাস প্রদান করেছে।তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কোনটা আগে, সুধীরকুমার সম্পর্কে এই বক্তব্য নাকি বনলতা সেন। এটাও জানা যায় না, চিত্রকল্পটা তিনি কখন কল্পনা করেছিলেন, ১৯২৯ সালে যখন তাঁর বন্ধুকে (সুধীরকুমার) দেখেন, তখন? নাকি আরও বহু পরে সুধীরকুমারের অকালমৃত্যুর পর, তিনি যখন দিল্লি স্টেশনের সেই সাক্ষাতের স্মৃতিচারণা করেছিলেন।

তবে এরপরে আমরা দেখব জীবনান্দের জীবনে আরও একাধিক বনলতা সেন এসেছেন। যেমন ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পরে ডাক্তার যখন বললেন নিয়মিত হাঁটতে, তখন সুবোধ রায় নামে একজন  বনলতা সেনের সন্ধান তিনি পান। জীবনানন্দের জীবনে সবশেষ বনলতা সেনের নাম শান্তি মুখার্জি––যিনি তাকে সবশেষ দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন হাসপাতালের বিছানায়।

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর বিকেলে সুবোধ রায়কে ছাড়া একাই হাঁটতে বেরিয়েছিলেন জীবনানন্দ। শাহাদুজ্জামানের ভাষায়, ল্যান্সডাউন রোড দিয়ে রাসবিহারী এভিনিউ ধরে গড়িয়াহাটা গোলপার্কের দিকে। হেমন্তকাল। পাতা ঝরছে চারদিকে। তিনি হাঁটছেন একা একা। ঝরা পাতা এসে পড়ছে তাঁর গায়ে। কী ভাবছেন তখন তিনি? মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি, নিজের, মানুষের। হাঁটতে হাঁটতে রাসবিহারী মোড়ে এসে পৌঁছান। তখন বালিগঞ্জ ডাউন ট্রামের ক্যাচারে আটকে যান নির্লিপ্ত, নির্ভার,  (সম্ভবত জীবনের প্রতি লেনদেন চুকানো) কবি। শম্ভুনাথ হাসপাতালে নেয়া হলো। রোগী একজন কবি জানতে পেরে নার্স শান্তি মুখার্জির মনে যেন দয়ার উদ্রেক হয়। তার উদ্বেগ বেড়ে যায়। যেন একটু বাড়তি সচেতন। যত্ন-আত্তিতে কমতি না হয়। শাহাদুজ্জামান লিখছেন, একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে তিনি জীবনানন্দের গা, মুখ মুছিয়ে দিলেন, চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিলেন চুল। তাঁর মাথার কাছের টেবিলে একটা ফুলদানিতে রেখে দিলেন ফুল। অপরিচ্ছন্ন ইমার্জেন্সির একটা কোণকে শান্তি করে তুললেন মরুদ্যান। ২২ অক্টোবর মৃত্যুবধি শান্তি মুখার্জি নামের এই নার্স, এই বনলতা সেন জীবনানন্দকে দুদণ্ড শান্তি দিয়ে যান। জীবন সায়াহ্নে কবিকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টায় কোনো খাদ রাখেননি এই নারী। 

যদিও নির্মম ইতিহাস বলছে, হাসপাতালে জীবনের শেষ কয়েকদিন জীবনানন্দকে দেখতে আসেননি তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশ; যিনি হতে পারতেন জীবনানন্দের জীবনের প্রধানতম বনলতা সেন। দুদণ্ড শান্তি দূরে থাক, সারা জীবনই একরকম টানাপড়েনের সম্পর্ক বুনে গেছেন তারা। শোনা যায়, লাবণ্য তখন ব্যস্ত ছিলেন টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে। মৃত্যুর পরে যখন কবিকে দেখতে আসছিলেন বিশিষ্ট কবি, লেখক ও বিশিষ্টজনেরা, তখন জীবনানন্দের বন্ধু ভূমেন্দ্র্র গুহকে কিছুটা তীর্যদক ভাষায় বলেছিলেন, অচিন্ত্য-বাবু এসেছেন, বুদ্ধ-বাবু এসেছেন, সজনী-কান্ত এসেছেন––তাহলে তোমাদের দাদা নিশ্চয় বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন; বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেক কিছু রেখে গেলেন হয়তো। কিন্তু আমার জন্যে কী রেখে গেলেন বলো তো ?

.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দুই তলায় ২৩০ নম্বর রুমে ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা দেয়ার পর আমাদের খুব চায়ের তৃষ্ণা পায় ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমরা জনাকয়েক সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণ দিকে যেতে যেতে অদূরে ফুটপাথে কূপিজ্বালানো একটি ডালায় হলুদ ডালপুরি আমাদের নজরে আসে।

রাখাল রাহা, আরশাদ সিদ্দিকী কিংবা শওকত হোসেনদের কেউই অম্বলজনিত কষ্টের ভয়ে এই পুরির দিকে নজর দেন না। আমার ওসব নেই। দেখা গেলো বৃদ্ধ দোকানি ডালপুরি চার টুকরো করে তাতে শশাকাটা, কাঁচামরিচ আর বিট লবন দিয়ে মুদ্রিত বইয়ের ছেঁড়া পৃষ্ঠায় পেঁচিয়ে দিচ্ছেন। 

ভাঁজ করে রাখা শখানেক কাগজের মধ্যে জীবনানন্দের ছবিসম্বলিত এই কাগজটিই জ্বলজ্বল করছিলো কুপির আলোয়। তাঁর আবার আসিব ফিরে কবিতার পৃষ্ঠা। কোন ক্লাসের বইয়ের পৃষ্ঠা তা অবশ্য উদ্ধার করা যায়নি। তবে তিনি যে ফিরে আসবেন বলেছিলেন, সেটির একটি অদ্ভুত দৃশ্যায়ন আমরা দেখলাম এই সন্ধ্যায়।

এই দৃশ্য দেখে আমার বনলতাকেই মনে পড়ে। থাকে শুধু অন্ধকার এখানে কিছুটা আলো আছে। মুখোমুখি বসিবার যে মানুষ, যে দুদণ্ড শান্তি দেয়তখন মনে হয় এই ডালপুরিওয়ালাই বনলতা সেন––যে কি না মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের এই ফুটপাথে আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন মৃত্যুর ছয় দশক পরে জীবনানন্দের এমন ফিরে আসার দৃশ্য দেখিয়ে।  জীবনানন্দ মৃত্যুর পরে কমলালেবু হয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন কোনো এক মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে। কিন্তু তিনি যে এভাবে ডালপুরি পেঁচানোর ঠোঙা হয়ে ফিরে আসবেন, তা হয়তো ভাবেননি। 

বনলতা সেন কবিতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে প্রাবন্ধিক অশোক মিত্র লিখেছেন, এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এল; সেইসঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবিতাটির অন্তঃস্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, না কি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনও জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে-সমস্ত খবর বেরোত। হয়তো ১৯৩২ সাল হবে, নয়তো তার পরের বছর, বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহি জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল, রাজশাহি থেকে নাটোর তো একচিলতে পথ। ইতবৃত্তের এখানেই শেষ। প্রাকস্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপিকা হয়েছিলেন, কলকাতার কলেজেও পড়িয়েছেন। বিবাহোত্তর পর্বে অন্য পদবি ব্যবহার করতেন, তাঁর সামান্য আলাপ হয়েছিল। ভব্যতাবশতই জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কবিতাটির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কি না। কিছু কিছু রহস্যকে অন্ধকারে ঢেকে রাখাই সম্ভবত শ্রেয়। (বনলতা সেন/বিক্ষিপ্ত অর্ধশতক/অশোক মিত্র) 

.
. আকবর আলি খান প্রসঙ্গে আসা যাক।তাঁর মতে,বনলতা বাংলাদেশে ব্যবহৃত কোনো সাধারণ নাম নয়। তার স্খলনের পরে নজের পরিচয় লুকানোর জন্য সে হয়তো ছদ্মনাম নিয়েছে। মি. খান এও যুক্তি দেন যে, বনলতার সেন পদবি প্রমাণ করে তিনি ভদ্রবংশ উদ্ভূত। অর্থাৎ তিনি বলতে চান যে, ভদ্র ঘরের এই নারী পতিতাবৃত্তি শুরু করার পরে তিনি তার আসল নাম বদলে ফেলেছিলেন। যেমন এই সময়েও যেসব নারী নানা কারণে এই পথে আসেন তারা ক্লায়েন্ট বা খদ্দেরের কাছে নিজের আসল নাম বলেন না। তারা নিজেদের নাম বলেন নদী,পাখি, লতা, আশা ইত্যাদি। ফলে জীবনানন্দের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকারী ওই নারীর নাম হয়তো অন্য কিছু। কিন্তু সেই নারী হয়তো নিজের নাম বলেছেন বনলতা অথবা জীবনানন্দই তার নামটি গোপন রাখার জন্য এই নামটি দিয়েছেন। আকবর আলি খান আমলা ছিলেন। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন। নাটোরেও ছিলেন অনেকটা সময়।তাঁর ভাষায়, বিংশ শতকের অনেক প্রশাসকই এ কথা লিখতে ভুলেননি যে নাটোর উত্তরবঙ্গের ‘‘রূপজীবীদের’’ (বেশ্যা বা পতিতা কিংবা গণিকার মার্জিত প্রতিশব্দ) একটি বড় কেন্দ্র ছিল। মি. খান জীবনানন্দের জীবনী বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছেন যে,১৯২৯ এর ডিসেম্বর ও ১৯৩০ এর জানুয়ারির মধ্যবর্তী কোনো সময়ে দিল্লিতে পতিতালয়ে যান।তাহলে তিনি নাটোরের কথা কেন লিখলেন? নারীর নামের মতো স্থানের নাম গোপনের জন্য? নাকি দিল্লির ওই অভিজ্ঞতার আগে-পরে তিনি নাটোরে গিয়েছিলেন অথবা দিল্লিতে যে নারীর সংস্পর্শে এসে দুদণ্ড শান্তি পেয়েছিলেন, সেই নারীর সাকিন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নাটোরে

আকবর আলি খান এই দুদণ্ড শব্দটির উপর জোর দিয়ে এটি প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, পতিতালয়ে একজন পুরুষ আসলে দুদণ্ড শান্তি পাওয়ার জন্যই যায়। এটি দীর্ঘস্থায়ী বসবাস কিংবা দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ঠিকানা নয়।
দুদণ্ড শান্তির আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে, বনলতা নামে ওই নারীর সঙ্গে জীবনানন্দের একবারই দেখা হয়েছিল এবং দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের কোনো ইঙ্গিত এই কবিতায় নেই। 

বনলতার সাথে জীবনানন্দের সম্পর্কটা যে অবৈধ ছিল, সেটি প্রমাণে মি. খান চার ধরনের যুক্তি দিয়েছেন।
. বনলতা সেন কবিতার নায়িকা অন্ধকারের প্রাণি (দেখেছি তারে অন্ধকারে) ১৮ লাইনের কবিতায় পাঁচবার অন্ধকার শব্দটি এসেছে।
. বনলতার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারবার বিনোদবালাদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। আর বিশেষ করে নাটোরের কথা বলেছেন কারণ বারবণিতার জন্য এই শহরের প্রসিদ্ধি ছিল।
. কবি বলেছেন, বনলতা সেন তাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল। দুদণ্ডের শান্তি কারা দেয় তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন আকবর আলি খান।
. বনলতার সাথে কবির পূর্ব পরিচয় ছিল না। যে কারণে তার সাথে যখন প্রথম দেখা হয়, বনলতা বিস্ময়ে আনন্দে শিহরনে জিজ্ঞেস করেছেন, এতদিন কোথায় ছিলেন! এটি সৌজন্যমূলক প্রশ্ন নয়। অর্থাৎ জীবনানন্দ যখন তাকে প্রেম নিবেদন করলেন, তখন বনলতা জানিয়ে দিয়েছেন যে, এখন আর এই ধরনের সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব নয়। কারণ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। পতিতালয়ে গিয়ে পতিতার প্রেমে পড়া এবং তাকে নিয়ে ঘরসংসার করার অনেক দৃশ্য সিনেমায় দেখা যায়। জীবনানন্দ হয়তো সেরকম নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বনলতা তাতে সায় না দিয়ে বলেছেন, এতদিন কোথায় ছিলেন। অর্থাৎ আরও আগে আসেননি কেন?

আকবর আলি খানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষন করে বলা যায়, প্রথমবার দেখা হয়েছিল বলেই যে বনলতা সেন তার কাছে জানতে চেয়েছেন এতদিন কোথায় ছিলেন’––এমনটি নাও হতে পারে। কারণ ব্যাখ্যাটা উল্টোও হতে পারে। ধরা যাক, বনলতার সঙ্গে তার আগেও দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে এবং তারপর থেকেই বনলতা সেন তার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। দীর্ঘকাল পরে যখন দেখা, তখন হৃদয়নিংড়ানো সেই প্রশ্নটি তিনি ছুড়ে দিয়েছেন, এতদিন কোথায় ছিলেন! অর্থাৎ আমি আপনার জন্য এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম।

তবে বনলতা সেনের কাছ থেকে দুদণ্ড শান্তি পেয়েছিলেন বলেই তাকে পতিতা বলে উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। কারণ দুদণ্ড শান্তির ব্যাখ্যা যে আমরা নানাজনের কাছ থেকেই পেতে পারি, সেই ব্যাখ্যা আগেই দিয়েছি।
বনলতা সেন নিয়ে জীবনানন্দের জীবদ্দশাতেই নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক ওঠে। কিন্তু তিনি নিজে এর কোনো ব্যাখ্যা দেননি। অনেকে বিরূপ মন্তব্য করলেও তিনি তা অপনোদনের চেষ্টা করেননি। তিনি এই কবিতার যে ইংরেজি অনুবাদ করেন, সেখানে যেন সচেতনভাবেই দুদণ্ড শান্তির প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন।  সেখানে তিনি বরং বনলতার প্রজ্ঞা বা Wisdom এর কথা লিখেছেন। I had Banalata Sen of Natore and her wisdom’ তিনি কি বনলতা নিয়ে বিতর্ক এড়াতেই এর ইংরেজি অনুবাদ করে এটিকে নৈতিক দিক দিয়ে ধোপ-দুরস্ত করেছেন? প্রশ্ন মি. খানের। 

তবে ফারুক ওয়াসিফের (জীবনানন্দের মায়াবাস্তব, পৃষ্ঠা ২৬) ব্যাখ্যা, জীবনানন্দ দাশের জীবনীতে কোনো বনলতা ছিল কি না কিংবা কোনো অসাধিত প্রণয়দুঃখের উদযাপন তিনি এই নামে করেন কি না, জীবনীকারের জন্য সেই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও কবিতার দার্শনিক সারসন্ধানে প্রশ্নটা অসার। দারোগার তদন্ত-তরিকা সাহিত্য বিচারে খাটে না। তাঁর কবিতার নারৗ নদী মানবীয় ওপ্রাকৃতিক দশা থেকে উত্তরিত হয়ে আরও বড় অর্থের প্রতীক বা সিগনিফায়ার হয়ে ওঠে। বনলতা সেন শুধু ব্যক্তিমানবী নন, ধানসিঁড়ি কেবলই বাংলার এক সামান্য নয় নয়; তা আরও বড় অর্থের দ্যোতক।
যেমন আমরা ভিঞ্চির মোনালিসার পরিচয় জানতে পারি না। ভিঞ্চি নিজেও তার পরিচয় দেননি। যদিও এই ভূবনবিখ্যাত চিত্রকর্মটির প্রতি মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তার হাসির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেরও অন্ত নেই।
আমরা জীবনানন্দের এই বনলতা সেনের পরিচয় জানতে যতটা উদগ্রীব, তাঁর কবিতার অন্য নারীগণ যেমন শঙ্খিনীমালা, সুরঞ্জনা কিংবা সুচেতনা পরিচয় জানতে অতটা নই। কেন? কারণ বনলতার সঙ্গে পদবি হিসেবে সেন এবং ঠিকানা হিসেবে নাটোর শব্দটি যুক্ত। সেইসাথে অন্ধকার ও দুদণ্ড শান্তি শব্দযুগলও এই আগ্রহের কারণ।   

তথ্যসূত্র:
বি সিলি, ক্লিনটন,অনন্য জীবনানন্দ
রায়চৌধুরী, মলয়,পোস্টমডার্ন জীবনানন্দ
খান, আকবর আলি, অন্ধকারের উৎস হতে
খান, আকবর আলি, চাবিকাঠির খোঁজে
মিত্র, অশোক, বিক্ষিপ্ত অর্ধশতক
শাহাদুজ্জামান, একজন কমলালেবু
ওয়াসিফ, ফারুক, জীবনানন্দের মায়াবাস্তব

No comments:

Post a Comment