আমীন আল রশীদ
খবরটা আমাদের হাতে আসে ১৫ এপ্রিল ভোরে। মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওই খবরে বলা হয়,৫ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারকে
ফেরত নিয়েছে মিয়ানমার। স্বভাবতই খবরটি আমাদের মধ্যে চাঞ্চল্য এবং সন্দেহ, দুটিই
তৈরি করে।
তাহলে কি অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাবাসন শুরু হয়ে গেলো? তবে খবরটি
নিয়ে সন্দেহের মূল কারণ ছিল, সেখানে রয়টার্স বরাত দিয়েছে শুধু মিয়ানমার
কর্তৃপক্ষের। বাংলাদেশের তরফে কোনো বক্তব্য ছিল না। ফলে আমরা প্রথমে শরণার্থী,
ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মাদ আবুল কালামের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি
জানান,১৪ এপ্রিল রাতে ৫ সদস্যের একটি পরিবার ফেরত গেছে। তবে এটি কোনোভাবেই প্রত্যাবাসনের বিষয় নয়। কারণ ওই
পরিবারটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে আসেনি। বরং তারা শূন্যরেখায় ছিল এবং সেখান
থেকেই তারা ফেরত গেছে। খানিক বাদে আমরা পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের বক্তব্যও পাই।
তিনি পরিস্কার জানান যে, একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে ফেরত নেয়ার যে দাবি মিয়ানমার
করছে, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় কিছুই জানে না।
এই ঘটনা গণমাধ্যমে আলোড়ন তুললে অনুসন্ধানে নামেন বাংলাদেশের
সাংবাদিকরা। তাদের কাছে তমব্রু সীমান্ত থেকে খালেদ নামে একজন রোহিঙ্গা নেতা জানান,
আক্তার আলম যে লোক ও তার পরিবারের ৪ সদস্য শূন্যরেখা থেকে মিয়ানমারে চলে গেছেন,
তিনি মিয়ানমারের একটি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি ছিলেন। যাওয়ার সময় কাউকে কিছু বলে
যাননি। শুধু তাই নয়, এমন খবরও গণমাধ্যমে এসেছে যে, মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া আক্তার
মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুপ্তচর। তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করতেন।
সাম্প্রতিক সহিংসতার সময় তিনিও অন্যান্য রোহিঙ্গার সঙ্গে প্রথমে শূন্যরেখায় এসে
আশ্রয় নেন। পরে সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের একটি পরিবারের সাথে থাকেন। কিন্তু তার
গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে তাকে বাসা থেকে বের করে দেয় ওই বাংলাদেশি পরিবার।
আক্তার মূলত বাংলাদেশ ও সীমান্ত এলাকার খবরা-খবর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে পাচার
করতেন। তার সঙ্গে মোবাইল ফোন ছিল। এই ঘটনায় যে প্রশ্নটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা
হলো,শূন্যরেখায় এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গা এখন আছেন, তাদের
মধ্যে এরকম আরও কতজন গুপ্তচর আছেন, যারা নিয়মিত এখানের তথ্য পাচার করছেন?
আরেকটি প্রশ্ন হলো, মিয়ানমার কেন একটি পরিবারকে ফেরত নিয়েছে বলে
প্রচার চালালো? জবাব সম্ভবত এই যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে একধরনে ধোঁয়াশা বা
ক্যামোফ্ল্যাজ তৈরি করে রাখার যে কৌশল তারা শুরু থেকেই নিয়েছে, এই ঘটনাও তারই
পৌনঃপুনিকতা। এই ঘটনাটি যতটা না বড় অথবা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।
কারণ একটি রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারকে ফেরত নেয়ার কথা প্রচার করে মিয়ানমার সারা
বিশ্বকেই বোকা বানানোর একটা কৌশল নিয়েছে। তারা বিশ্বকে এরকম একটি বিভ্রান্তিকর
বার্তা দিতে চেষ্টা করেছে বা করবে যে, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে খুবই
আন্তরিক এবং কোনো ধরনের জোরজবরদস্তি ছাড়াই রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরছে।
ফলে প্রত্যাবাসান ইস্যুতে কোনো ধরনের চুক্তি বা সমঝোতার প্রয়োজন নেই। তারা হয়তো
এটিও প্রচার করতে চাইবে যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে মিয়ানমার যথেষ্ট আন্তরিক,
কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে প্রস্তুত নয়।
এই ঘটনার দিন কয়েক আগেই আরেকটি খবর গণমাধ্যমে আসে। সেটি হলো, রাখাইনে
রোহিঙ্গা হত্যার দায়ে দেশটির ৭ সেনা সদস্যকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে
মিয়ানমার। সাজাপ্রাপ্ত সাতজনের মধ্যে চারজনই সেনা কর্মকর্তা। সাজা দেওয়ার পাশাপাশি
তাদের সেনাবাহিনী থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। গত বছর রাখাইনে ১০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা
করার দায়ে তাদের এই সাজা দেওয়া হয়।খবরে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং
হ্লাইংয়ের ফেসবুক পাতায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, সামরিক আদালতে দণ্ডিত এসব
সেনা সদস্যদের ১০ বছর কারাভোগের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কঠোর পরিশ্রমের কাজেও
নিযুক্ত থাকতে হবে।
এরপর ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সফরে আসেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও
পুনর্বাসনমন্ত্রী ড. উইন মিয়ায়ে। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন
এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দেন। যদিও মিয়ানমার
সরকারের যে কাঠামো এবং সেখানে সেনাবাহিনীর যে প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ, সেখানে সামান্য
একজন সমাজকল্যাণমন্ত্রীর পক্ষে এই আশ্বাসও একধরনের আইওয়াশ বা দৃষ্টিধোয়া। তাছাড়া
এরকম আশ্বাস যদি সে দেশের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও দিতেন,
তারও একটা কূটনীতিক মূল্য তৈরি হতো। একজন মন্ত্রী যিনি বস্তুত ত্রাণ ও পুনর্বাসন
নিয়ে কাজ করেন, তার পক্ষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার মতো একটি অতি স্পর্শকাতর এবং
অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আশ্বাস কতটা গুরুত্ব বহন করে, তা প্রশ্ন বটে। তবে
মিয়ানমারের একজন মন্ত্রীর এই সফর এটা প্রমাণ করে যে, মুখে মুখে মিয়ানমার সরকার
রোহিঙ্গা ইস্যুতে যত আবোল-তাবোল কথাই বলুক না কেন, তারা যে একটা আন্তর্জাতিক চাপে
আছে এবং সমস্যার সমাধান না করলেও কিছুটা ভানও এখন তাদের করতে হচ্ছে। অর্থাৎ
পরিস্থিতির চাপে পড়ে এখন তাদের কিছু আইওয়াশ করতেও হচ্ছে। এটুকু সৌজন্যও তারা আগে দেখায়নি।
অবশ্য এসব আলোচনা আর তর্ক-বিতর্কের
মাঝে যে প্রশ্নটি হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে তা হলো, রোহিঙ্গা নিধনের বিচার। জাতিগত
নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর
ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হলেও হত্যা, নিযাতন, ধর্ষণ ও জাতিগতভাব
একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূলের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের কথা সেভাবে
উচ্চারিত হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া যেমন জরুরি তেমনি জরুরি ওই নিষ্ঠুর
কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিচার। যদিও সম্প্রতি এই ইস্যুতে একটা আইওয়াশ মিয়ানমার করেছে
যার মধ্য দিয়ে তারা বিশ্বকে একটি ইতিবাচক বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ সাত
সেনা সদস্যের ১০ বছর করে কারাদণ্ড। বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গা নিধনের এই সিদ্ধান্তটি
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। মাঠ পযায়ের কোনো একজন সামরিক কর্মকর্তা বা সেনা
সদস্য নিজের ইচ্ছে মতো রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে এবং অন্যান্য অপরাধ করেছ–এটি ভাবার
কারণ নেই। বরং রাখাইন রাজ্যে যা হয়েছে তা সবই পূর্বপরিকল্পিত এবং একটি জনগোষ্ঠীর
শেকড় উপড়ে ফেলার নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত। ফলে তারা যখন দাবি করে যে সাত সেনা
সদস্যকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, এটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এখন সমস্যা
হলো, রাখাইন বা এরকম অতি স্পর্শকাতর জায়গায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি
নেই; আবার মিয়ানারের নিজস্ব সাংবাদিকরাও অতটা স্বাধীন বা নিরপেক্ষ নন। ফলে আসলেই
ওই সেনা সদস্যদের শাস্তি হয়েছে কি না বা হলেও সেটি কতটা লেখাদেখানো আর কতটা
বাস্তব, তা জানা খুবই কঠিন। কিন্তু তারপরও কথা হচ্ছে, মিয়ানমার ওই সাত সেনা
সদস্যকে শাস্তি দিক বা না দিক, এই খবরটি প্রচার করে তারা অন্তত এটি প্রমাণ করেছে
যে, তাদের উপর রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ বড় ধরনের চাপ আছে। ফলে এই চাপটি অব্যাহতভাবে
বাড়াতে হবে বিচারের দাবি জোরলো করতে হবে।
যুদ্ধাপরাধ আদালতের কৌঁসুলি ফাতাও বেনসুউদা সম্প্রতি জাতিগত নিধনের
শিকার হয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি তদন্তে আইনী অধিকার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ
আদালতের (আইসিসি) হস্তক্ষেপও চেয়েছেন। মিয়ানমারে সংগঠিত ওই নিধনকে সম্ভাব্য
মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে অভিহিত করে তিনি এই আবেদন করেন। আইসিসি এটি অনুমোদন
করলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তদন্ত ও বিচার কাজ সহজ হবে বলে মনে করা হয়। যদিও
মিয়ানমার এ কাজে মোটেই সহায়তা করবে না।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যাংককভিত্তিক
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিস ডেভিস বলেছেন, টাটমাডো নামে পরিচিত মিয়ানমারের
সেনাবাহিনী কয়েক দশক ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে
ছোটখাটো বিদ্রোহ দমনে অভিযান চালিয়েছে। ওই সময়গুলোতে তাদের নৃশংসতার কোনো বিচার
হয়নি। ফলে তারা আরও বেশি আগ্রাসী ও নৃশংস হয়ে উঠেছে। যার সবচেয়ে বড় ভিকটিম
রোহিঙ্গারা। ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা যতটা জোরেশোরে
বলতে হবে, তেমনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যারা এই জাতিগত
নিধনে ইন্ধন জোগায় তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এবং এক্ষেত্রে একদিনে
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের চাপ এবং অন্যদিকে আইসিসিকেই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে।
শোনা যাচ্ছে, চলতি মাসের শেষদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি
প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশ আসবে যেখানে রাশিয়ারও একজন সদস্য
থাকবেন, যে রাশিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে বস্তুত মিয়ানমারের পক্ষেই রয়েছে। শুধু রাশিয়া
নয়, মিয়ানমারে বিপুল বিনিয়োগ থাকায় চীন এবং রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং অনেক ক্ষেত্রে
অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় ভারতও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে––যা এই সংকট
উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে অনেক বড় অন্তরায়। আবার নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের
বাংলাদেশ সফরে আসা এবং কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার পরও রোহিঙ্গাদের
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া কতটা সহজ হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকবেই। কারণ
এরইমধ্যে নানাভাবে মিয়ানমার সরকার এটি জানান দিয়েছে যে, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত
নেয়ার ইস্যুতে মূলত টালবাহানাই করবে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের বাংলাদেশ সফরের
আগে-পরে মিয়ানমার হয়তো এই ইস্যুতে আরও কিছু আইওয়াশ করবে––যাতে অনেকের
মনে হবে যে, এই বুঝি তারা সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়ে গেলো! কিন্তু বাস্তবে তা খুব
সহজে হবে না। যে ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে আছে, শেষবধি তাদের কত শতাংশকে
মিয়ানমার ফেরত নেবে, তা কিছুটা আন্দাজ করা যায় বটে, কিন্তু যেহেতু এটি এখন আর
বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক
রূপ পেয়েছে এবং খোদ জাতিসংঘ (বিশেষ করে মহাসচিব) বাংলাদেশের পাশে রয়েছে বলে
প্রতীয়মাণ হচ্ছে, তাই বৈশ্বিক কূটনীতি এবং মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ
(প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা) কতটা প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে, তার উপরেও নির্ভর করবে আখেরে
কতজন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ফেরত পাঠাতে পারবে।
##

No comments:
Post a Comment