Friday, February 9, 2018

কোকাপ শহর


আমীন আল রশীদ
এই শহরে জিনপরি থাকে। সম্ভবত ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে আমরা এই শহরে প্রথম পা রাখি। লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমে বাদামতলির গা ঘেঁসে মিটফোর্ডের সুগন্ধ নাকে মেখে আমরা জেলখানার পাশ দিয়ে পলাশীর প্রান্তরে যেতে যেতে মাছের উৎকট গন্ধ পাই, যে গন্ধ আমাদের গ্রামের মাছেদের শরীরে থাকে না।
আব্বা বলেছিলেন, এই কোকাপ শহরের মাছেদের শরীর নাদুশ নুদুশ রাখার জন্য এদের গায়ে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল মাখা হয় যার নাম ফরমালিন। এই ফরমালিন এক ধরনের বিষ যা এই কোকাপ শহরের মানুষ প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু খায়। কিন্তু এই জিনপরিদের শহরে থাকা মানুষের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং জীবনীশক্তি এতই বেশি যে এই বিষ তাদের শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। বরং কোনোদিন কোনো মাছকে এই ফরমালিনের জলে না ডুবালে সেই মাছ ক্রেতারা দোকানে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসে। বলে আপনের মাছে কোনো টেস নাই।
আমাদের কৈশর এই শহরের আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠে। আমরা ইশকুলে যাই। বিকালে সরু গলি পার হয়ে আমরা সংসদ ভবনের উল্টো দিকে ইন্দিরা রোড খেলার মাঠের একটি ছোট্ট অংশের দখল নিয়ে ক্রিকেট খেলি।  কোকাপ শহরে মাথপিছু মাঠের সংখ্যা নগন্য। ফলে আমরা কখনো বিজি প্রেসের মাঠে অথবা কলাবাগান মাঠে বড়দের মাঠে নামার আগে খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরি এবং জিনপরিদের গল্প করি।
সংসদ ভবনের খেজুর বাগানে, চন্দ্রিমা উদ্যানের ভেতরে যেখানে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির কবর এবং সংলগ্ন লেকের পানিতে আমাদের বন্ধু ইয়াসিন বহুদিন জিনপরি দেখেছে বলে আমাদের সাথে চাপাবাজি করে। আমরা প্রমাণ চাইলে সে ধানাইপানাই করে। আমরা ইয়াসিনকে একদিন লেকের পানিতে চুবাই এবং সে স্বীকার করে যে, সে কোনোদিন জিনপরি দেখেনাই। 
তারপর বহুদিন আব্বাকেও বলেছি জিনপরি দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি বলতেন জিনপরি লালবাগ কেল্লায় থাকে, যেখানে তোর বড় চাচার মেয়ে রাশিদার বাসা। তিনি বলতেন, জিনপরি কিছু দেখা যায় আহসান মঞ্জিলের দেয়ালে, গাছের আবডালে, বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে, কোনাকাঞ্চিতে। আহসান মঞ্জিলে তোর যে হাবিব চাচা চাকরি করে, সেও বহুদিন জিনপরি দেখছে।
আমরা হাবিব চাচাকে জিজ্ঞেস করি জিনপরি দেখতে কেমন। তিনি হাসেন। বলেন, বড় হইলে বুঝবি। আমরা বড় হই এবং হাবিব চাচার ছেলেদের সঙ্গে এ নিয়ে গল্প করি। কিন্তু তারা কোনোদিন জিনপরি দেখেছে বলে আমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আমরা বুড়িগঙ্গার তীরে সোয়ারিঘাটে যাই। নৌকায় নদী পার হয়ে  ইস্পাহানি গিয়ে সেঝ মামার শ্বশুরের বাসায় বিকেলে মোগলাই পরোটা খাই এবং তার শ্যালককে জিজ্ঞেস করি, তারা কখনো জিনপরি দেখেছে কি না।
২০০৫-০৬ সালের দিকে আমরা একাধিবার জিনপরি দেখেছি পরিবাগে। আব্বা বলতেন, এক সময় ওইখানে জিনপরি গিজগিজ করত। এখানে যে পিকক বার, সেখানে ছিল পরিদের আস্তানা। আর যেখানে এখন সাকুরা বার,  সেটি ছিল জিনদের পানশালা। তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে পরবর্তীতে সরকার ওখানে একটা পানশালা খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পিকক বার তৈরির ফলে সেখান থেকে পরিদের আস্তানা উচ্ছেদ করা হয়। তারা আশ্রয়হীন হয়ে কিছুদিন অদূরে রমনা পার্কে বসবাস করে। কিন্তু সকালবিকাল সেখানে ডায়াবেটিক রোগীদের মূত্রপাতে তারা বিরক্ত হয় এবং আরেকটু এগিয়ে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সেখানে সতেরজনের বেশি পরিকে জায়গা দিতে পারে না। ফলে অধিকাংশ পরি গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজার, হাইকোর্টের মাজার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুরুদুয়ারা নানকশাহীর  কম্পাউন্ড এবং ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় এবং ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকারের কেয়ারটেকার আমলে ওই এলাকা আর্মিদের টেককেয়ারে চলে গেলে পরিরা নতুন সঙ্কটে পড়ে এবং অনেকেই আত্মহত্যা করে বলে অসমর্থিত সূত্রে খবর পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

No comments:

Post a Comment