আমীন আল রশীদ
বিজ্ঞাপনের ধর্মই হলো, সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিসটি কেনার জন্য সে আপনাকে
এমনভাবে প্রলুব্ধ করবে যাতে মনে হবে, এটি না কিনলে আপনি পিছিয়ে থাকবেন। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন
হচ্ছে একধরনের সুড়সুড়ি বা প্রলোভন যাতে সব বয়সী মানুষ প্রভাবিত হয়। রাস্তার পাশে দোকানে ঝোলানো চিপসের প্যাকেট দেখলেই যেমন
বাচ্চারা সেটি খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে, বিজ্ঞাপনও আমাদের মধ্যে সেরকম হাহুতাশ তৈরি
করে। অথচ ওই জিনিসটি না হলে আমাদের কিছুই যায় আসে না।
চরম বাজে সেবার কোনো পণ্যও যখন দেশপ্রেম বা ভালোবাসার কোনো গল্পের মোড়কে
বিজ্ঞাপিত হয়, তখন সেটি মানুষের মনে গাঁথে। এভাবে অপ্রয়োজনীয় কিংবা ক্ষতিকর জিনিসগুলোর
প্রতি ভোক্তাদের ভালোবাসা তৈরি হয়। যে কারণে বলা হয়, বিজ্ঞাপন হচ্ছে এমন জিনিস
যে, জাহান্নামের বিজ্ঞাপন দেখেও আপনার মনে হবে, এখনই সেখানে যাওয়া উচিত।
কিন্তু প্রশ্নটা অন্যখানে। ধরা যাক, আপনার শিশুসন্তান কোনো ক্ষতিকর পণ্যের
বিজ্ঞাপন দেখে সেটি কিনে দেয়ার জন্য বায়না ধরলো এবং না দিলে সে চিৎকার করছে, তখন আপনি
কী করবেন? টেলিভিশন বন্ধ করে দেবেন নাকি সেই ক্ষতিকর পণ্যটি কিনে দেবেন? এরকম একটি
সমস্যায় পড়েই মূলত এই নিবন্ধটি লিখতে উদ্বুদ্ধ হই এবং সমস্যাটা নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস
দিলে বন্ধুদের অনেকেই বিষয়টি নিয়ে লেখার পরামর্শ দেন।
আমার মেয়ের বয়স সাড়ে তিন বছর। ডাক্তারের পরামর্শে জন্মের পর থেকে ওকে
আমরা কখনোই কৃত্রিম দুধ খাওয়াইনি। হরলিক্স বা এরকম কোনো পণ্য তো নয়ই। কিন্তু ইদানীং
সে হরলিক্স খেতে চায়। টেলিভিশনে যখনই এই পণ্যটির বিজ্ঞাপন দেখে এবং দেখে যে শিশুরা
হরলিক্স খাচ্ছে এবং ‘তরতর করে বেড়ে
উঠছে’, তখন আমার মেয়ে বলে, ‘বাবা আমাকে হরলিক্স কিনে দাও। আমিও বড়
হব।’ তাকে এটা বোঝানো মুশকিল যে, হরলিক্স খেলেই
বড় হয় না।
আরেকটা বিজ্ঞাপন পেপসোডেন্ট টুথপেস্টের। যেখানে দেখানো হয়, মিষ্টি, টকলেট
বা এ জাতীয় জিনিস যতই থাক না কেন, পেপসোডেন্ট থাকলে ক্যাভিটির ভয় নেই। আমার মেয়ে চকলেট
খায় এবং একসাথে অনেকগুলো খেতে তাকে বাধা দেয়া হলে সে ওই বিজ্ঞাপনের দোহাই দিয়ে বলে,
‘পেপসোডেন্ট দিয়ে দাঁত মাজবো।’ ফলে এই ছোট্ট শিশুর যুক্তির কাছে আমাদের
হার মানতে হয়। আবার টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়াও কোনো সমাধান নয়।
২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি খবরে (হরলিক্স
‘প্রতারণা’, ফয়জুল সিদ্দিকী)বলা
হয়েছিল, স্বাস্থ্য গঠনের অন্যতম উপাদান ডিএইচএ
এর নাম করে বাজারজাত করলেও জুনিয়র হরলিক্সে সে উপাদান পায়নি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প
গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। খবরে বলা হয়, নিজের বাচ্চার জন্য বাজার থেকে জুনিয়র হরলিক্স
কিনে কৌতূহলের বশে প্রতিষ্ঠানটির একজন বিজ্ঞানী পরীক্ষা করে ডিএইচএ বা ডেকোসাহেক্সানয়িক
এসিড পাননি শিশুদের জন্য তৈরি ওই খাদ্যে।স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৮ সালে মিথ্যা দাবি
করে বিজ্ঞাপন প্রচার করায় হরলিক্সের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রক
সংস্থা এএসএ।
ফেসবুকে যখন হরলিক্স ও পেপসোডেন্ট বিষয়ক সমস্যাটা নিয়ে লিখলাম, তখন কেউ
কেউ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খোঁচা দিয়ে লিখেছেন, বিজ্ঞাপন প্রচার না করলে আপনাদের টেলিভিশন
চলবে কী করে? কেউ কেউ লিখেছেন, এসব ক্ষতিকর পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধের উদ্যোগটা
আপনারাই নিন ইত্যাদি। কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা জানেন, বিজ্ঞাপনদাতারা কী ভীষণ ক্ষমতাবান!
খোদ হাইকোর্টও বলেছেন যে, আমাদের দেশে আমের জুস নামে যেসব পণ্য বিক্রি হয়, সেগুলোর
ভেতরে আমের অস্তিত্বই নেই। অথচ সেসব পণ্য আমের জুস হিসেবেই বিজ্ঞাপিত এবং বিক্রিত হচ্ছে।
এর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা সহজ নয়। মোবাইল ফোন কোম্পানির সেবা নিয়ে গ্রাহকের অভিযোগের
শেষ নেই। কিন্তু মোবাইল ফোনের বিরুদ্ধে কখনো কোনো রিপোর্ট আপনার চোখে পড়েছে? হ্যাঁ,
কিছু রিপোর্ট হয়েছে বা এখনও হয়। তখন হয়, যখন কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই মোবাইল
ফোন কোম্পানির দেন-দরবারে সমস্যা হয়। ফলে চাইলেই হরলিক্স, ফেয়ার এন্ড লাভলী বা পেপসোডেন্টের
বিজ্ঞাপন বন্ধ করা যে সহজ নয়, সেই বাস্তবতাটি সাধারণ ভোক্তার জায়গা থেকে উপলব্ধি করা
কঠিন।
যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘যোগাযোগ’-এর ‘টেলিভিশন’ সংখ্যায় (সংখ্যা ১২, প্রকাশ জুলাই, ২০১৬)
সাংবাদিক প্রভাষ আমিন (বিজ্ঞাপন, কেবল অপারেটর, টিআরপি: বাঘের ওপর তিন ‘টাগ’) লিখেছেন, ‘গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন
দেয়া হয় পণ্যের প্রচার এবং প্রচারের মাধ্যমে প্রসারের জন্য। বাংলাদেশের অনেক কোম্পানির
পণ্য আছে, যার যথেষ্ট প্রসার আছে, প্রসারের জন্য আর বিজ্ঞাপন দেয়ার দরকার নেই। অনেক
কোম্পানি আছে যাদের ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের সক্ষমতা নেই। তারপরও তারা দিনের
পর দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে যান। কেন? এই বিজ্ঞাপন পণ্যের প্রচারের জন্য নয়। এই বিজ্ঞাপন
গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বা গণমাধ্যমকে হাতে রাখার জন্য। যাতে তাদের পণ্য নিয়ে
কোনো নেতিবাচক রিপোর্ট ছাপা না হয়।’
বলা হয় কোনো একটি পণ্যের উৎপাদন খরচ যা, তার বিজ্ঞাপন খরচ তারও চেয়ে
বেশি। আবার সেই বাড়তি খরচটা তোলা হয় ভোক্তার কাছ থেকেই। ধরা যাক, একটি পণ্যের উৎপাদন
খরচ ৮ টাকা, এটি প্রচারের জন্য খরচ করা হলো ১০ টাকা এবং সেটি বিক্রি করা হলো ২৫ টাকায়।
তার মানে বিজ্ঞাপন না থাকলে এটি অর্ধেক দামে বিক্রি করা যেতো। কিন্তু সমস্যা হলো, বিজ্ঞাপন
ছাড়া ওই পণ্যের সম্পর্কে ভোক্তা জানবে না এবং যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি এবং সেখান থেকে
মুনাফার টার্গেট, তা পূরণ হবে না। ফলে পণ্যের বিজ্ঞাপনটি এমনভাবে বানানো হয় যাতে ভোক্তারা
সেটি কিনতে বাধ্য হয়।
প্রশ্ন ওঠে তাহলে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ কী করে? ২০০৯ সালে প্রণীত
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, ‘কোনও পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের জন্য
অসত্য বিজ্ঞাপন দ্বারা ভোক্তা সাধারণকে প্রতারিত করা হচ্ছে কি না, তা তদারকি করে প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা গ্রহণ ; মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য সামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির
উপর বাধানিষেধ আরোপ; কোনও পণ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত
হলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পরামর্শক্রমে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা সমগ্র
দেশে বা কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় ওই পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের
জন্য প্রদর্শন,বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহণ বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে
বন্ধ করা বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ওইসব কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার
বিষয়ে নির্দেশ জারি করতে পারবে।’
মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করার শাস্তির বিধানও
রয়েছে এই আইনে। যেমন বলা হয়েছে, সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন
দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই
লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সমস্যা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের নীতিমালা থাকলেও
সরাসরি বিজ্ঞাপন বিষয়ক কোনো নীতিমালা নেই। আবার বেসরকারি টেলিভিশনগুলো নারী ও শিশুদের
বিষয়ে কিছু লিখিত বা অলিখিত নীতিমালা মেনে চললেও বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তাদের কারো নীতিমালা
আছে বলে মনে হয় না। তবে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার খসড়ায় (এখনও চূড়ান্ত হয়নি) বিজ্ঞাপন
বিষয়ে একটি বড় অধ্যায় রয়েছে এবং সেখানে নারী ও শিশুদের বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু নির্দেশনা
রয়েছে। যেমন: এমন কোনও বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না, যাতে শিশু মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হয়। দুধ
জাতীয় পণ্যের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। কোনও
খাদ্যপণ্য বা পানীয়র বিজ্ঞাপনে অবশ্যই এর পুষ্টি উপাদান এবং স্বাস্থ্যের প্রভাব
সম্পর্কে পরিস্কার তথ্য থাকতে হবে। বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে
স্বীকৃত পদ্ধতি মানতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, হরলিক্স বাচ্চাদের ‘টলার (আরও লম্বা) স্ট্রংগার(আরও
শক্তিশালী) শার্পার (আরও তীক্ষ্ণ)’ করে, এটি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য কি না? তাছাড়া মিথ্যা তথ্য
দেয়ায় যে বিজ্ঞাপন যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা আমাদের দেশে কীভাবে চলে?
শিশুদের জন্য দেশের প্রথম বিশেষায়িত টেলিভিশন ‘দুরন্ত’ টিভিতে ‘ওয়ার্ল্ড গার্ল’ নামে একটি কার্টুন প্রচারিত
হয়। এর একটি পর্বে দেখানো হয়েছে, একজন অসৎ ব্যবসায়ী শহরের সব অভিভাবকের মধ্যে ঢুকিয়ে
দেন যে, আজ সব শিশুর জন্মদিন। টেলিভিশনে ওই বিজ্ঞাপন দেখে অভিভাবকরা দলে দলে দোকানে
ছোটেন এবং নিজেদের সন্তানদের জন্য অজস্র উপহার কিনতে থাকেন। অধিকাংশ শিশুই তাদের জন্মদিন
না হওয়া সত্ত্বেও এই উপহার পেয়ে বেজায় খুশি। কিন্তু কেউ কেউ প্রশ্ন করে, আজ তো তার
জন্মদিন নয়, তাহলে কেন উপহার? তখন তার ভাই বা বোন তাকে এই বলে চুপ করিয়ে দেয় যে, জন্মদিন
হোক বা না হোক, উপহার তো পাওয়া গেলো! কিন্তু উৎসুক শিশুরা এই ঘটনার তদন্তে নামে এবং
ওই দুষ্ট ব্যবসায়ীর ফাঁদ আবিষ্কার করে। বিজ্ঞাপন মূলত এরকম বিশাল এক ফাঁদ, যাতে আমরা
এবং আমাদের সন্তানরা প্রতিনিয়তই হাবুডুব খাচ্ছে।

No comments:
Post a Comment