আমীন আল
রশীদ
কে হচ্ছেন
দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি–এ
নিয়ে দেশের রাজনীতির অঙ্গন খুব বেশি উত্তপ্ত নয়,
যতটা উত্তপ্ত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় (৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা
করা হবে) এবং নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার ইস্যুতে।
রাষ্ট্রপতি
দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে সম্মানীয় নাগরিক। অথচ নিরবে নিভৃতে মো. আব্দুল হামিদ যে
বঙ্গভবনে পাঁচ বছর পার করে দিলেন, তা যেন দেশের মানুষ টেরই পেল না। তিনি আবারও এই পদে বহাল হচ্ছেন নাকি নতুন
কোনও মুখ আসছেন, তা এখনও নিশ্চিত নয়। কিন্তু এ নিয়ে দেশের
মানুষের মধ্যে খুব একটা উৎসাহ আছে বলে মনে হয় না। কারণ সাংবিধানিকভাবেই আমাদের
রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতার একজন মানুষ।
দেশের
ইতিহাসে এ পর্যন্ত ১৭ জন ব্যক্তি (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বিচারপতি
আবু সাঈদ চৌধুরী,মোহাম্মদউল্লাহ, খন্দকার
মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম,জিয়াউর রহমান, আব্দুস সাত্তার, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, আফম আহসানুদ্দিন চৌধুরী,
শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আবদুর রহমান বিশ্বাস,
একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জমিরুদ্দিন সরকার,ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, জিল্লুর রহমান, আব্দুল হামিদ) রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ
একাধিকবারও দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ১৭ জনের মধ্যে ৫ জন ছিলেন বিচার বিভাগ থেকে
আগত ।
মহান
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে সরকার গঠিত হয়, সেটি ছিল মন্ত্রিপরিষদ শাসিত। যদিও ১৯৭৫ সালের
২৫ জানুয়ারি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা চালু করেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টানা ১৬ বছর এই ব্যবস্থার অধীনেই সরকার পরিচালিত
হয়েছে। তবে ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে
দেশে সংসদীয় পদ্ধতি চালু হয় এবং রাষ্ট্রপতির পদটি নিছক অলঙ্কারে পরিণত হয়।
সংসদীয়
পদ্ধতি চালুর প্রাক্কালে সংবিধানের যে ১২তম সংশোধনী আনা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এতটাই নিরঙ্কুস করা
হয় যে, পুরো রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামোয় রাষ্ট্রপতিকে একজন ‘নিধিরাম সর্দারে’ পরিণত করা হয়। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন
আনুষ্ঠানিকতার বাইরে কোনও নীতি-নির্ধারণে আদতে তাঁর করার কিছুই নেই। অথচ ওই সময়ে
যদি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য রাখার একটি বিধান যুক্ত করা হত, তাহলে পরবর্তীকালে দেশে যেসব রাজনৈতিক সংকট
তৈরি হয়েছিল, তার অনেকগুলোই এড়ানো যেত বলে মনে করা হয়।
রাষ্ট্রের
প্রধান তিনটি (আইন, বিচার, নির্বাহী)
অঙ্গের মধ্যে আইন ও নির্বাহী বিভাগ মূলত অভিন্ন। কারণ প্রধানমন্ত্রী
একইসঙ্গে সংসদনেতা এবং দলীয় প্রধান। আবার রাষ্ট্রপতিকে সব কাজ করতে হয়
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। এমনকি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে হলেও সেখানে
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রয়োজন। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী আসলে
রাষ্ট্রপতিও। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংসদকে যখন যে ধরনের আইন প্রণয়নের
নির্দেশ দেবেন, সংসদ সেটি করতে বাধ্য। অর্থাৎ বিদ্যমান
সংবিধান কেবল প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারই নয়, বরং এটি
একধরনের একনায়কতান্ত্রিকতারও রক্ষক। রাষ্ট্রপতিকে সব কাজ যদি প্রধানমন্ত্রীর
পরামর্শক্রমেই করতে হয় এবং রাষ্ট্রপতির যদি আদৌ কোনো ক্ষমতা না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপতি পদের কোনো প্রয়োজন আছে কি না,সে
প্রশ্নও নানা সময়ে উঠেছে।
সংবিধানের
৪৮ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের
অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের
দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন
করিবেন।’ কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি
নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর
পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন বলেও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে।
এই বিধান
পড়ে এটি মনে করার কোনও কারণ নেই যে,
প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কেননা নির্বাচনে জয়ী
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন,সেটিই
স্বীকৃত। রাষ্ট্রপতির পক্ষে এখানে অন্যথা করার সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি কে
হবেন, তাও যে রাষ্ট্রপতি ঠিক করেন না, তা
সবাই বোঝেন। কারণ প্রধান বিচারপতি কে হবেন, সেটি নির্বাহী
বিভাগের এখতিয়ার না হলেও এটি অনেক বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকারকে এখানে
অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হয়। যতই বলা হোক না কেন যে, বিচার
বিভাগ স্বাধীন, সেটা যে আসলে কেতাবী কথা, এতে বোধ করি কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। সুতরাং এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির যে
এখতিয়ারের কথা বলা হয়, সেটির বাস্তবতা ভিন্ন।
কোনও আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের দণ্ডের
মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করা বা কারো সাজা মওকুফ, স্থগিত বা
হ্রাস করার যে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে,
সেখানেও তিনি স্বাধীন নন। বরং প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই তিনি
কাউকে ক্ষমা করেন।
জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী
দিনে রাষ্ট্রপতি যে ভাষণ দেন, সেটিও মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হতে হয়। অর্থাৎ নির্বাহী
বিভাগ তাঁকে যেরূপ কথা বলার অনুমতি দেবেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি কেবল ততটুকুই বলবেন।
সংসদে রাষ্ট্রপতির এই ভাষণের পদ্ধতি শুনে কারও মনে হতে পারে যে, তিনি বোধ হয় সরকারের
মুখপাত্র। রাষ্ট্রপতি কি সরকারের মুখপাত্র? প্রসঙ্গত, সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ৭৩) এটি বলা
নেই যে, সংসদে রাষ্ট্রপতির এই ভাষণ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হতে হবে। বরং ১৯৯৬ সালে একটি
বিশেষ প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভা একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এই বিধান চালু করে।
আবার অর্থবিলে রাষ্ট্রপতি কোনো ধরনের মতামত
বা পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করে সংসদে ফেরতপাঠাতে পারবেন না। এখানে সংসদ যা পাস করবে
রাষ্ট্রপতি তাতেই সই দিতে বাধ্য। মানে হলো, সরকার রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা
খরচ করবে, কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতির কিছু বলার নেই।
তবে ক্ষমতা
যাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রপতি পদে মেয়াদ কিন্তু নির্ধারিত। অর্থাৎ একটানা হোক বা না হোক,
দুই মেয়াদের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারবেন না। যদিও
প্রধানমন্ত্রীগণ চাইলে অনন্তকালও পদে থাকতে পারেন। এখানে তাদের কোনো মেয়াদের
সীমাবদ্ধতা নেই। অর্থাৎ যখন সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সংবিধানে সংশোধন করা হলো,
তখন সচেতনভাবেই প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া
হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচিত হলে একজন ব্যক্তি তিন/চার মেয়াদেও প্রধানমন্ত্রী থাকতে
পারেন।
২.
বলা হয়, সাংবিধানিকভাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীগণ যে
ক্ষমতা ভোগ করেন, সেটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি।
তিনি চাইলে দিনতে রাত এবং রাতকে দিন করতে পারেন সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই।
তিনি যেকোনও আইন প্রণয়নের জন্য সংসদকে পরামর্শ দিতে পারেন এবং ৭০ অনুচ্ছেদের ভয়ে
ভীত আইনপ্রণেতাগণ সেই আইনের পক্ষে ভোট দিতে হাঁ জয়যুক্ত করে থাকেন। এখানে
রাষ্ট্রপতির কিছুই করার নেই। তিনি যদি ওই বিলে সই নাও করেন, তারপরও
সেটি ১৫দিন পরে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদিত হয়ে যাবে। সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদে
বলা হয়েছে,রাষ্ট্রপতির কাছে কোনও বিল পেশ করার পর ১৫ দিনের
মধ্যে তিনি তাতে সম্মতি দেবেন।তবে অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনও বিলে বিশেষ বিধান
পুনর্বিবেচনা কিংবা কোনও সংশোধনী বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বিলটি সংসদে ফেরত
পাঠাতে পারবেন। কিন্তু এই সময়ে মধ্যে রাষ্ট্রপতি যদি তা করতে অসমর্থ হন, তাহলে মেয়াদের অবসানে (১৫ দিন)
তিনি বিলটিতে সম্মতি দিয়েছেন বলে গণ্য হবে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রপতিগণ বস্তুত রাষ্ট্রের সবচেয়ে
সম্মানীয় নাগরিক এবং একটি প্রতীক ছাড়া কিছু নন। সংবিধানই তাঁর হাত পা বেঁধে
দিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা জারি করতে হলেও তাকে
প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। সুতরাং কে রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন, সেটি দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে বলে মনে
হয় না।
তাই কে
হচ্ছেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি তা নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও
গণমাধ্যমের খবর বলছে, এখনও তালিকার শীর্ষে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদই আছেন। তবে আওয়ামী
লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং স্পিকার
শিরীন শারমিন চৌধুরীর (যদি হন তাহলে তিনি হবেন দেশের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি) নামও
রয়েছে।
কেউ কেউ মনে
করেন, যেহেতু ২০১৮ সাল
বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর, অর্থাৎ এ বছরের
শেষদিকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন (জাতির
উদ্দেশে ভাষণ, ১২ জানুয়ারি, ২০১৮),
সুতরাং নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যু নিয়ে যদি বিরোধী পক্ষ বড় কোনো
আন্দোলন গড়ে তোলে এবং তার ফলে দেশ এক/এগারো কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন
পূর্ববর্তী পরিস্থিতির দিকে মোড় নেয়, তখন রাষ্ট্রপতি হয়তো
তার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে পরিস্থিতি উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারবেন। কেননা ৫১ অনুচ্ছেদ
অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিংবা অনুরূপ বিবেচনায় কোনও কাজ
করে থাকলে সেজন্য তাকে কোনও আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না। এই বিধানের আলোকে
রাষ্ট্রের কোনও সংকটকালে রাষ্ট্রপতি একজন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। সব
কাজে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার পরামর্শ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তিনি আদৌ
পরামর্শ নিয়েছেন কি না বা কী পরামর্শ করেছেন,কোনও আদালতে সেই
প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। আবার সংবিধানই বলে দিয়েছে, রাষ্ট্রপতির
বিরুদ্ধে কোনও আদালতে কোনও প্রকার ফৌজদারী কার্যধারা দায়ের করা বা চালু রাখা যাবে
না এবং তাকে গ্রেপ্তারও করা যাবে না। সুতরাং অনেকে এটি বিশ্বাস করেন যে, যিনি পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন, আগামী নির্বাচনের
প্রাক্কালে তাকে অনেক বড় দায়িত্ব নিতে হতে পারে।

No comments:
Post a Comment