Tuesday, January 16, 2018

নির্বাচনকালীন সরকার বলে কিছু নেই

স্বাভাবিক নিয়মে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে তার জন্য হাতে আছে আরও অন্তত ১১ মাস। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ২৪দিন পর অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি শুরু হয় ১০ম সংসদের যাত্রা।  সে হিসেবে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। গত ১২ জানুয়ারি এই মেয়াদে সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চলতি বছরের শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে এবং এর আগে গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সরকার, যে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বোতভাবে সহায়তা দেবে। প্রশ্ন হলো, সংবিধানে নির্বাচকালীন সরকার বলে আদৌ কিছু কি আছে ? যদি না থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রী যে ধরনের সরকার গঠনের কথা বলেছেন, সেটি কীসের ভিত্তিতে হবে? 


সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।  তবে মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনও কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
ধরে নেওয়া যায়, নির্ধারিত সময় ৫ বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারিই সংসদের মেয়াদ শেষ হবে।  তার মানে ওইদিনের আগেই নির্বাচন হতে হবে।  সেটি ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারিও হতে পারে; আবার সরকার চাইলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেও করতে পারে। 

সংবিধানে অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকলেও এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে: সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে কাউকে মন্ত্রী নিয়োগ করার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত আগে যারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, তারা বহাল থাকবেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন সামনে রেখে যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় অথবা সংসদ বহাল রেখেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়, তারপরও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে বহাল থাকবেন।  আর ওই অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার সদস্য নিতে হবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই।
  
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও এরকম একটি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল।  তখন বিএনপি সংসদে থাকলেও তারা এই সরকারে তাদের কোনও প্রতিনিধি দেয়নি।  এমনকি তারা ওই নির্বাচন বয়কট করে।  ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যখন আবার এই অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি আলোচনায় আসছে, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, এবারও কি বিএনপিকে এই সরকারে তাদের প্রতিনিধি চাওয়া হবে? সাংবিধানিকভাবে সেই সুযোগ নেই।  কারণ সেখানে স্পষ্টই বলা আছে যে, সংসদ ভেঙে দেওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেই মন্ত্রি নিয়োগ করতে হবে ।  আবার ৫৮-এর ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় যেকোনও সময়ে কোনও মন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল করা যাবে।

যদিও বিএনপি বলেছিলন যে তারা নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা দেবে। কিন্তু এ নিয়ে তাদের অগ্রগতি আসলে কতটুকু, তা পরিস্কার নয়। বরং ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরে বিএনপি এই ইস্যুতে সংলাপের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বিএনপির সাথে কোনো সংলাপে কারা আগ্রহী নয়। বাস্তবতা হলো, বিএনপি যে ধরনের নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি জানাচ্ছে অর্থাৎ শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ নির্বাচকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটি করতে গেলে প্রথমেই সংবিধান সংশোধন করে ৫৬ অনুচ্ছেদ বদলাতে হবে।  

সংবিধানে সরাসরি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা না হলেও রাষ্ট্রপতি চাইলে একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন।  আবার সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয় সে বিধানও রয়েছে ৭২ অনুচ্ছেদে।  অর্থাৎ একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন শুরুর বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৭২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকারের ওই ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন বসবে না।

কথা হচ্ছে, নির্বাচন হবে কার অধীনে? সংবিধান মোতাবেক যদি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সামনে রেখে সংসদ ভেঙে দেন অথবা সংসদ বহাল রেখে্ই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেন, সেখানে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটি ভাবার কোনও কারণ নেই।  কিন্তু বিএনপি বারবারই বলছে, তারা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না এবং তারা নির্বচানকালীন একটি নিরপেক্ষ (এখন আর নির্দলীয় বলে না) সরকার চায়।

গত নির্বাচনের আগে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা যত সহজ ছিল, এবার তার সুযোগ নেই বললেই চলে।  একটি পথ হতে পারে যদি বিএনপির ওই প্রতিনিধি বা প্রতিনিধিদের জাতীয় সংসদের কোনও আসন থেকে উপনির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী করে আনা যায়।  সেক্ষেত্রে ওই আসন বা আসনগুলোর বর্তমান এমপিদের পদত্যাগ করাতে হবে।  এর বাইরে অন্য কিছু করতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।  কিন্তু এ দুটির কোনোটিই যে শেষমেষ হবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

তবে বিএনপি যে ধরনের নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছে, তার সারাংশ হচ্ছে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারো অধীনে নির্বাচন; যা বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সম্ভব নয়।  তাহলে কি বিএনপি এবারও নির্বাচন বয়কট করবে? বোধ হয় না।  তারা যে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে, তা এরইমধ্যে মোটামুটি নিশ্চিত, যদি এই সময়ের মধ্যে কোনও মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা না হয় বা নির্বাচনের সময় যদি খালেদা জিয়া জেলে না থাকেন।  কারণ সংসদের বাইরের বিরোধী দলের চেয়ে সংসদের ভেতরে থেকে বিরোধিতা করা যে উত্তম, তা বিএনপি নেতারা ভালো জানেন।  আবার পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন থাকবে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।  সবচেয়ে বড় কথা, পরপর দুবার নির্বাচনের বাইরে থাকলে দল হিসেবে বিএনপি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং দলের ভেতরে একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়।

ফলে আগামী নির্বাচনের আগে যে এই অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম হবে, তা ধারণা করা যায়।কিন্তু জটিলতা হবে যদি এই ইস্যুতে আবারও ২০১৩ সালের মতো দেশে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়।  কারণ ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনীতিকরা যা করেন, তাতে সাধারণ মানুষের কোনও সমর্থন না থাকলেও আখেরে কোপটা পড়ে তার ঘাড়েই।


No comments:

Post a Comment