আমীন আল রশীদ
মানবিক কারণে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের
আশ্রয় দিয়ে এখন নিজেই বিপদে পড়ছে বাংলাদেশ। এ যেন খাল কেটে কুমির আনার অন্য নাম। মিয়ানমারের রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনীর
গণহত্যা, জেনোসাইড ও এথনিং ক্লিনজিং বা জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে কোনোমতে
প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের স্থানীয় অধিবাসীদের জানমালের
জন্যই হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। যে সংকট আরও অনেক পরে হওয়ার কথা ছিল, সেটি যেন
যথেষ্ট আগেই শুরু হয়ে গেলো।
প্রায় প্রতিদিনই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা
ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয় বাংলাদেশিদের নানাবিধ সংঘাত-সংঘর্ষের খবর সংবাদ
শিরোনাম হচ্ছে। শুধু মানুষের জানমালই নয়, রোহিঙ্গাদের কারণে এরইমধ্যে কক্সবাজারের
উখিয়া-টেকনাফে উজাড় হয়েছে বনভূমি, ধ্বংস হয়েছে বন্যহাতির আবাস ও বিচরণস্থল। লাখ
লাখ মানুষের পয়ঃবর্জ্য বিষিয়ে তুলছে ওই এলাকার পরিবেশ। ফলে মিয়ানমারের রাখাইনে
একটি ভয়াবহ সংকটের হাত থেকে কোনোমতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে এই
সংকট এখন এক নতুন রূপ পেয়েছে; যার সরাসরি ভিকটিম তাদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ।
শনিবার কক্সবাজারের রামুতে রোহিঙ্গাদের
হামলায় আব্দুল জব্বার নামে এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। তার নাম যার সাথে বন বিভাগের সামাজিক বনায়নের জমি নিয়ে
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জিয়াবুল হক ও তার ফুফু ভেওলা খাতুনের বিরোধ ছিল। শনিবার
সকালে বাগান পাহারা দেওয়ার সময় আব্দুল
জব্বারের ওপর হামলা চালায় জিয়াবুল ও ভেওলা খাতুন।
এর আগের দিন শুক্রবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার
বালুখালীতে কয়েকজন রোহিঙ্গার হামলায় চার বাংলাদেশি আহত হন।গণমাধ্যমে পুলিশের যে
ভাষ্য এসেছে তা হলো, বালুখালী ২ নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের পাশে শুক্রবার রাত
১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে টিউবওয়েল সারানোর কাজ করছিলেন মিস্ত্রিরা। এ সময় ‘ডাকাত
ডাকাত’
বলে পাশের ক্যাম্প থেকে কয়েকজন রোহিঙ্গা তাদের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে ধারালো
অস্ত্র দিয়ে তাদের আঘাত করা হয়। ঘটনার পর ক্যাম্প থেকে অস্ত্রসহ দুই রোহিঙ্গাকে
আটক করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে গুলিসহ দেশীয় দুটি এলজি উদ্ধার করা হয়। রোহিঙ্গা
ক্যাম্পে এ ধরনের অস্ত্র কী করে প্রবেশ করলো, তা খতিয়ে দেখা যেমন জরুরি, তেমনি
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে কতজনের কাছে এ ধরনের অস্ত্র আছে এবং
আশ্রয় নেয়া নিরীহ মানুষদের মধ্যে এরকম সহিংসতাপ্রবণ লোকের সংখ্যা কত––তা
জানা খুব মুশকিল।
এটি খুবই স্বাভাবিক যে, লাখ লাখ
রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে আশ্রয় দেয়ার ফলে সেখানের পাহাড় ও বনভূমি উজাড় হবে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তুলতে এ পর্যন্ত
দেড় হাজারেও বেশি একর জমির সামাজিক বনায়ন ধ্বংস করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের সহায়তায়
এই বনায়ন করেছিল বনবিভাগ। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব
না হলে এবং ফের বনায়ন করা না গেলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সঙ্গে পাহাড় ধসের ঝুঁকিও রয়েছে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে বনবিভাগের আরও অনেক
জমি রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাবে––তাতে সন্দেহ নেই।
কোনো এলাকায় এভাবে বনভূমি ধ্বংস হলে
তার সরাসরি প্রভাব যেমন ওই এলাকার পরিবেশের ওপর পড়ে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদে সেখানের
ইকোসিস্টেম বদলে যায়। সেখানের প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়ে। রোহিঙ্গাদের প্রতি
মানবিকতা দেখাতে গিয়ে কক্সবাজারের প্রাণ-প্রকৃতি ও স্থানীয় মানুষের জানমালের যে
ক্ষতি এরইমধ্যে হয়েছে, সেটি সরকার বা আন্তর্জাতিক বিশ্ব কীভাবে পোষাবে, তা আমরা
জানি না।
সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়, বাংলাদেশে আশ্রয়
নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার কারণে এখন কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে স্থানীয় অধিবাসীরাই
সংখ্যালঘু। তাদের কৃষিজমি ধ্বংস হচ্ছে। দোকানপাটে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত
হচ্ছে। এসব কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে প্রথমে তাদের যে সহমর্মিতা ছিল, তা এখন
ক্রমশই রোষে পরিণত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরকে তারা এখন নিজেদের জীবন-জীবিকার জন্য
হুমকি মনে করছে। এভাবে চলতে থাকলে ছোটখাট মারামারি, খুনোখুনি বড় ধরনের সহিংসতায়
রূপ নেবে। লাখ লাখ মানুষের মধ্যে এই সহিংসতার উন্মদনা ছড়িয়ে পড়লে তা কত ভয়াবহ আকার
ধারণ করবে––তা
ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। সুতরাং সেরকম পরিস্থিতি তৈরির আগে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে
ফিরিয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তার কোনো লক্ষ্মণ আপাতত নেই। এমনকি
রোহিঙ্গাদের ভাষানচরে আশ্রয় দেয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তাও খুব দ্রুত সম্ভব নয়। লাখ
লাখ মানুষের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু এই কাজে যত বিলম্ব
হতে থাকবে, স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ ততই বাড়তে থাকবে।
মানবিকতার খাতিরে আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয় মানুষের বিরক্তি ক্রমশ
বিতৃষ্ণায় রূপ নেবে।
আরও আতঙ্কের খবর,রাখাইন প্রদেশের
উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ফসলি জমি থেকে ধান কেটে নিতে শুরু করেছে দেশটির
কৃষি অধিদপ্তর। শনিবার মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের
এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাখাইনের মংডু অঞ্চলের ৭১ হাজার একর জমি থেকে ধান
কেটে নেওয়ার সরকারি আদেশ পেয়ে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এর অর্থ হলো রোহিঙ্গাদের
সেখানে আর প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এটি রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বিতাড়নেরই কৌশল।
মিয়ানমার সরকার বিশেষ করে সে দেশের
সেনা প্রধান এবং বৌদ্ধ নেতাদের যে উগ্র মানসিকতা তাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া
রোহিঙ্গাদের কতজনকে তারা ফিরিয়ে নেবে, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যদিও
মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। কিন্তু তারা সেই চাপ কতটুকু আমলে নিচ্ছে,
তাও ভেবে দেখা দরকার।
সম্প্রতি মিয়ানমার সফর শেষে দেশে ফিরে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের আশার বাণী শুনিয়ে বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সু
চি সরকারের সাথে আলাপ হয়েছে এবং তারা এ ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু পরদিনই মিয়ানমারের
সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সাথে কোনো
সমঝোতা হয়নি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, রোহিঙ্গা সংকটের শুরু মিয়ানমারের রাখাইনে
হলেও, আখেরে এর মূল্য দিতে হবে বাংলাদেশকেই। তবে সেই মূল্যের পরিমাণ বা অঙ্কটা
কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনই বলা কঠিন।
আমীন আল রশীদ:
সাংবাদিক ও লেখক।

No comments:
Post a Comment