আমীন আল রশীদ
ফয়সল আরেফিন দীপন। বার দুয়েক তাঁর
আজিজ মার্কেটের অফিসে গিয়েছি। সেই সামান্য আলাপেই মনে হয়েছে, তিনি একজন অগ্রসর
চিন্তার মানুষ। তবে তাঁর প্রতি আমার আগ্রহের আরেকটা কারণ ছিল, তাঁর বাবা আবুল
কাশেম ফজলুল হক। একজন আলোকিত মানুষ; যিনি নির্মমভাবে সন্তানের মৃত্যু দেখেও অবিচল
ছিলেন। নিজের কাঁধে বয়েছেন সন্তানের লাশ। ন্যায়বিচার পাবেন না জেনে বলেছিলেন,
সন্তান হত্যার বিচার চান না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক
যখন বলেন যে, সন্তান হত্যার বিচার চান না, সেখানে কী বিপুল অভিমান আর ক্ষোভ এবং
রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য সেটি কত বড় বার্তা, তা আমরা বুঝি কি বুঝি না, জানি না। কিন্তু
বাবা বিচার চান না বলে কি দেশের মানুষও এই হত্যার বিচার চায় না? যদি বিচার না হয়
তাহলে আইনের শাসন নিশ্চিত হবে কী করে? কিন্তু গত দুই বছরেও এই হত্যা মামলার আদৌ
কোনো অগ্রগতি কি আছে? যদি না থাকে তাহলে মি. হক যে বলেছিলেন, বিচার চান না, কেন
চান না, তাহলে কি সেটিই প্রমাণিত হচ্ছে?
গণমাধ্যমের খবর বলছে,জাগৃতি
প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার দুই বছরেও এর কূল-কিনারা
হয়নি। তদন্ত শেষ করতে এ পর্যন্ত ২২ বার সময় নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৫ সালের
৩১ নভেম্বর আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে
দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার দিন ধার্য করা
হয়। কিন্তু আদালত থেকে ২২ বার তারিখ দিলেও তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ
হচ্ছে।ঢাকার অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনিসুর রহমানের
বরাতে এনটিভি অনলাইনের এক খবরে বলা হয়েছে,আগামী ২১ নভেম্বর এ মামলার তদন্ত
প্রতিবেদন দেয়ার জন্য দিন ধার্য রয়েছে।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে জানা যায়,দীপন
হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা তিনজনই হত্যার
ঘটনায় ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
দীপনকে কেন খুন করা হয়েছিল বা কারা খুন করেছিল সেটি কোনো ধোঁয়াশার বিষয়
নয়। দীপন হত্যাসহ আরও বিভিন্ন ঘটনায় যে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম জড়িত, তা বিভিন্ন
সময়ে আইশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্কার করেছে। আর কারা আনসার আল ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম কিংবা জেএমবি অথবা
নব্য জেএমবি; কী তাদের উদ্দেশ্য এবং কেন দীপনরা টার্গেট––তা আর গোপন কিছু নয়। একটা উগ্র মতাদর্শিক
লড়াই এসব খুনের অনুঘটক। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের অনেকের জবানবন্দিতেও তা পরিস্কার
হয়েছে। কারো কারো জবানবন্দিতে এমনও তথ্য
বেরিয়ে এসেছে যে, সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টার অভিযোগে বরখাস্ত মেজর জিয়াই এসব
হত্যাকাণ্ড ও হামলার পরিকল্পনাকারী। তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব হত্যা ও হত্যাচেষ্টার
ঘটনা ঘটে।
হলি আর্টিজানের পরে জঙ্গিবিরোধী
বিভিন্ন অভিযান হয়েছে এবং অনেকে নিহত হয়েছে। অনেকে জীবিত ধরা পড়েছে। কিন্তু এখনও
একটি বড় প্রশ্ন, মেজর জিয়া কোথায়? শুধু দীপন হত্যা নয়, আরও অনেক ঘটনার রহস্য জানতে
তাকে প্রয়োজন বলে মনে করেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, কিছুদিন বিরতির পরপরই
যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি আস্তানার সংবাদ পাওয়া যায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
অভিযান হয়, তাতে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক রয়েই গেছে। বিশেষ করে যখন
দেখা যাচ্ছে যে, পরিবারের নারীদেরও এই কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে ঠিক কতগুলো
পরিবার এরইমধ্যে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হয়েছে এবং তারা কতটা সংগঠিত, আরও কারা তাদের
টার্গেট, তা আমরা জানি না।
তবে এটুকু জানি যে,
দীপনরা পার্থিব কোনো চাওয়া-পাওয়া যেমন টাকা-পয়সা বা ব্যবসায়িক বিরোধের কারণে খুন
হননি। তাদের খুনের নেপথ্যে রয়েছে একঝাঁক বিপথগামী তরুণের মগজধোলাই। যারা ইসলামের
ভুল বার্তা বা ভুল ব্যখ্যায় বিভ্রান্ত। যারা মনে করে, মানুষকে খুন করে এবং নিজে
খুন হলেই সরাসরি বেহেশতে চলে যাওয়া যাবে। কিন্তু এই ধারণা যে ইসলামের মৌলিক ধারণার
সঙ্গেই সাংঘর্ষিক, তা এই বিভ্রান্ত তরুণেরা জানে না। তবে এর পেছনে অর্থাৎ
বিশ্বব্যাপী উগ্রপন্থা বা আরও পরিস্কার করে বললে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে যে
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বেশ সক্রিয়, তা এরইমধ্যে প্রমাণিত। কীভাবে এবং কারা আইএস-এর
মতো সংগঠনের জন্ম দিয়েছে, তা এখন আর লুকোছাপার কোনো বিষয় নয়।
কিন্তু বিপদ অন্য
জায়গায়। তা হলো, এরকম উগ্রবাদী বা সহিংস সংগঠনের জন্মের পেছনে যতই আন্তর্জাতিক
ষড়যন্ত্র থাকুক না কেন, স্থানীয় পর্যায়ে
ক্ষেত্র প্রস্তুত না হলে এ ধরনের সংগঠনের বিকশিত হবার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সমাজে যদি
ন্যায়বিচারের সংকট তৈরি হয়, যদি কোনো একটি গোষ্ঠী নিজেদের প্রান্তিক ভাবা শুরু
করে, যদি তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে, যদি তারা ভাবে যে কোনো একটি গোষ্ঠীর প্রতি
রাষ্ট্রীয়ভাবেই অন্যায় করা হচ্ছে, তাহলে সেখানে, বিশেষ করে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে
উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ বিকশিত হতেই পারে। এর বাইরে রাজনীতির নানা খেলাও এই আগুনে ঘি
ঢালে। যেমন যুদ্ধারাধীর বিচার ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামি সারা দেশে যে ধরনের নাশকতা
সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল, তারাও যে এইসব জঙ্গি তৎপরতাকে উসকে দিয়েছিল বা তারা যে এসব
ঘটনার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে, তাও বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে।
তাহলে এ থেকে বের হবার
উপায় কী? উপায় খুব কঠিন জেনেই আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছিলেন,সন্তান হত্যার বিচার
চান না। কারণ তিনি জানেন, এক দীপন হত্যার বিচার হলেও ঠিক যে কারণে এই খুনের ঘটনা ঘটলো,
তার মূলোৎপাটন কঠিন। বছরের পর বছর ধরে যে
আদর্শিক লড়াই, যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই
চলছে, যেভাবে একটি বড় জনগোষ্ঠী, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত তরুণেরাও যে লড়াইয়ে
শামিল হয়েছে এবং বইখাতা ছেড়ে যখন সম্ভাবনাময় তরুণও হাতে ধারালো চাপাতি নিয়ে কথিত
নাস্তিকের পেছনে ধাওয়া করে, সেরকম একটি অন্ধকার সময়ে সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে একা
আবুল কাশেম কী করবেন?
দীপনরা যে বড় অন্যায় করে
ফেলেছে। তারা মুক্তচিন্তার কথা বলেছে। তারা প্রশ্ন করেছে। সক্রেটিসও কথিত
জ্ঞানীদের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে দেখেছেন তারা আসলে মূর্খ। ফলে শতাব্দীর পর
শতাব্দী ধরেই প্রশ্ন করা বা মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধ শক্তিই প্রবল। সেই শক্তির
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যে অস্ত্রে এবং য ভাষায় লড়াই করতে হবে––তার নাম জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। তার নাম সহনশীলতা। জঙ্গিবাদের
বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি। অভিযান শেষে এর সাফল্য নিয়ে সংবাদ সম্মেলন দেখছি।
সরকারের চোখেমুখেও তৃপ্তির ছাপ দেখছি, এই বুঝি সব জঙ্গি নির্মূল হয়ে গেলো। কিন্তু
জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে যে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটা দরকার, সেটি আমরা আদৌ
করতে পারছি কি না? যদি না পারি, তাহলে দীপন হত্যার বিচার চেয়ে লাভ নেই।

No comments:
Post a Comment