আমীন
আল রশীদ
উত্তরটা
প্রশ্নের ভেতরেই আছে। কেননা, দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনও কোনো বিচারপতির ছুটি নিয়ে
এত আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক হয়নি–যা
হচ্ছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বেলায়।
১৩
অক্টোবর রাতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছড়েন। এর আগে ৫ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বিদেশে
যাওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতির ভিসার আবেদন বিষয়ে আইনমন্ত্রী তখন সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে মি. সিনহার সঙ্গে তার কোনা কথা
হয়নি। এর আগে ওইদিন দুপুরে আইনমন্ত্রী দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল
ওয়াহহাব মিঞার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
২৫
দিনের অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার দিনই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১
নভেম্বর পর্যন্ত এক মাসের ছুটিতে যান সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এরপরই জানা যায়, তিনি
বিদেশে যাচ্ছেন। ১০ অক্টোবর তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে তার বিদেশ
ভ্রমণের বিষয়টি চিঠি দিয়ে অবহিত করেন। ওই চিঠিতে ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর
পর্যন্ত তিনি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে চান বলে উল্লেখ করা হয়।
মনে
রাখা দরকার, মি. সিনহার বিরুদ্ধে যখন সংসদে এবং সংসদের বাইরে নানাবিধ বিষোদ্গার
চলছিল, যখন ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও পর্যবেক্ষণ বাতিলের দাবি জনাচ্ছিলেন সংসদ সদস্যরা
, ওই সময়ে তার অর্থসম্পত্তি নিয়েও কিছু আলোচনা হয়। একটি টেলিভিশন চ্যানেল এ বিষয়ে
একাধিক প্রতিবেদনও করে। প্রশ্ন তোলে তার উত্তরায় বাড়ি নিয়েও।
এটি
খুব পরিস্কার যে, প্রধান বিচারপতির এই ছুটির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে ষোড়শ
সংশোধনীর রায় ও পর্যবেক্ষণ। সরকারের সাথে তার টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে এই রায়ে
উল্লিখিত কিছু মন্তব্য, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, বিচার
বিভাগের স্বাধীনতা, একক নেতৃত্ব ইত্যাদি ইস্যুতে। তাছাড়া অধস্তন আদালতের বিচারকদের
শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়েও তার সাথে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। একাধিকবার
তিনি এজলাসে এই ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেছেন। এমনকি তিনি এও বলেছেন যে, ‘সরকার বিচার বিভাগের টুটি চেপে ধরতে চায়’।যদিও অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ১২ অক্টোবর
তিনি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন ও
শক্তিশালী এবং তিনি আইনের শাসনে আস্থাশীল।
কিন্তু
তারপরও প্রধান বিচারপতির এই ছুটিকে যদি আমরা অস্বাভাবিক বা বিচার বিভাগের ওপর
একধরনের চাপ বলে মনে করি তাহলে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যেমন–
১.
এই ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। দেশে এবং দেশের বাইরে এরকম একটি বার্তা
যাবে যে, সরকার মি. সিনহাকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করেছে। অর্থাৎ এটি একধরনের অপসারণ।
২.
বিএনপিসহ আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষের ধারণা ছিল, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের ধারবাহিকতায়
মি. সিনহা হয়তো বর্তমান সংসদের ১৫৩ জন অনির্বাচিত সংসদ সদস্যকে অবৈধ ঘোষণা করবেন
অথবা ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউয়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবেন–সেই সম্ভাবনা তিরোহিত হলো।
৩.
বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ কিংবা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল––যার হাতেই থাকুক, ভবিষ্যতে যেকোনো সরকার
চাইলেই প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠাতে পারবে, তাতে সংসদ কিংবা সুপ্রিম জুডিশিয়াল
কাউন্সিল কোনোকিছুরই প্রয়োজন হবে না।
৪.
মি. সিনহার এই ঘটনায় যদি বিচারপতিরা কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে থাকেন, তাহলে তারা
ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধে যায় বা সরকারের কোনো নীতি বা সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে––এমন কোনো রায় দিতে সংশয় বোধ করবেন।
৫.
কাগজে-কলমে বা মুখে মুখে যতই বলা হোক না কেন যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন––কার্যত এটি যে নির্বাহী বিভাগ থেকে
সেপারেটেড বা আলাদা ছাড়া কিছুই নয়, সেই ধারণাটি মানুষের মনে বদ্ধমূল হবে।
৬.
সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক
বিচারকার্যে স্বাধীন থাকবেন বলা হলেও তারা যে সব সময়, বিশেষ করে রাজনৈতিক
স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় তারা যে অনেক সময়ই স্বাধীন নন, সেই ধারণাটি আরও স্পষ্ট
হবে।
৭.
যদি তাই হয় তাহলে ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতি, নির্বাচন, গণতন্ত্র ইত্যাদির সংস্কার
প্রশ্নে সরকার যা চায়, তার বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছুর বাস্তবায়ন আদালত চাইলেও করতে
পারবেন না।
তবে
আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার এই ছুটি আসলেই
স্বাভাবিক এবং ছুটি শেষে তিনি কাজে যোগ দেবেন। সেইসাথে ৩১ জানুয়ারির পরে, অর্থাৎ
যেদিন তার মেয়াদ শেষ হবে, তখন একটি সম্মানজনক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাকে বিদায়
জানানো হবে। কিন্তু যদি এটি না হয় এবং যদি এই ছুটি প্রলম্বিত হতে থাকে এবং এভাবে
তার অবসরের সময় চলে আসে––তখন আর এই
ছুটিকে স্বাভাবিক বলে মনে করার কোনো অবকাশ থাকবে না।
No comments:
Post a Comment