Thursday, September 28, 2017

উন্নয়ন সাংবাদিকতা মানেই আলু-পটলের বাম্পার ফলন নয়


আমীন আল রশীদ
হালে ‘উন্নয়ন’ শব্দটি আমাদের যাপিত জীবন, বিশেষ করে রাজনীতিতে এত বেশি ব্যবহৃত এবং উচ্চারিত যে, অনেক সময় শব্দটি নিয়ে নানাবিধ মশকরাও হয়। কখনও ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ শব্দটি নিয়ে রসিকতা বা উপহাসও চলে। যেমন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন দেশের গণমাধ্যমের ওপর সুস্পষ্ট সেন্সরশিপ ছিল এবং তৎকালীন সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের প্রেসক্রিপশনে বহু রাজনীতিবিদের কথিত জবানবন্দিও অধিকাংশ গণমাধ্যম ছাপতে বাধ্য হয়েছিল, ওই সময়ে আমরা রসিকতা করে সহকর্মীদের বলতাম, ‘সিরিয়াস রিপোর্টিং বাদ দিয়া উন্নয়ন সাংবাদিকতা করেন। যেমন সেলাই শিখে স্বাবলম্বী সাথী; মুন্সিগঞ্জে আলুর বাম্পার ফলন; নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করলো ব্রি ইত্যাদি।’ এখন প্রশ্ন হলো, এগুলোই কি উন্নয়ন সাংবাদিকতা?


‘উন্নয়ন’ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? অর্থনীতিবিদরা নানাবিধ তত্ত্ব ও  সংজ্ঞা দিলেও একজন দিনমজুরের কাছে বা স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে উন্নয়ন মানে গতকাল যেরকম ছিলাম, আজ তার চেয়ে একটু ভালো থাকা।  অর্থাৎ উন্নয়ন মানে ইতিবাচক বা কাক্সিক্ষত পরিবর্তন। এখানে জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, চাহিদা, জোগান ইত্যাদি খটমট শব্দ সাধারণ নাগরিকের জীবনকে খুব একটা স্পর্শ করে না। রাজনীতিবিদরা উন্নয়ন বলতে মানুষের সামনে যা হাজির করেন, তার অনেক অনুষঙ্গ নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায় এবং নাগরিকরা এই প্রশ্ন করতে পারছে কি না¬¬Ñসেটিও উন্নয়নের একটি সূচক বলে মনে করা হয়।

রাজনীতিবিদরা নিজেদের উন্নয়ন করেন। যেমন নির্বাচনের আগে হলফনামায় তিনি ব্যক্তিগত সম্পদের যে তথ্য (সত্য মিথ্যা মিলিয়ে) দেন, পরবর্তী নির্বাচনের সময় দেখা যায় সেই সম্পদের আকার বহু গুণ বেশি। যে ছাত্রনেতা পায়ে হেঁটে বাসা থেকে কলেজে/বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন, দেখা গেলো বড় পদ-পদবি পাওয়ার পর তিনি  হেলিকপ্টারে চড়ছেন। তার মানে তার নিজের উন্নতি হচ্ছে। অর্থাৎ তিনি গতকালের চেয়ে আজ ভালো খাচ্ছেন, ভালো চড়ছেনÑসে হিসেবে এটি তার ব্যক্তিগত উন্নয়ন। কিন্তু এই পরিবর্তনকে আমরা উন্নয়ন বলতে পারি না।

উন্নয়নের একটা বড় সূচক হলো দৃশ্যমানতা অর্থাৎ অবকাঠামো। যেমন বড় বড় ফ্লাইওভার, চার লেনের রাস্তা, রাস্তায় দামি গাড়ি, মেট্রোরেল, সেতু, বহুতল ভবন ইত্যাদি। মানুষের যোগাযোগ সহজ করতে এসব উন্নয়নের বিকল্প নেই। কিন্তু যখন এক বর্গফুট রাস্তা বা একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি হয়, যখন কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ দফায় দফায় বাড়তে থাকেÑসেটিকে আমরা উন্নয়ন বলতে পারি কি না, সেই প্রশ্ন তোলাও সঙ্গত।

ফলে প্রশ্ন হলো, উন্নয়নটা আসলে কার হচ্ছে? রাজনীতিবিদের? ঠিকাদারের? প্রকল্প কর্মকর্তার? সরকারি কর্মকর্তার? চিফ ইঞ্জিনিয়ারের? বলা হবে, তাদের উন্নয়ন হলেও আখেরে এর সুফল তো জনগণই পাচ্ছে। রাস্তা,  সেতু বা ফ্লাইওভার নির্মাণে দুর্নীতি হলেও সাধারণ মানুষই তো সেসব ব্যবহার করছে, অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা আছে। কেননা, ওই টাকাটা রাষ্ট্রের, মানে জনগণের। সুতরাং উন্নয়ন সাংবাদিকতা হচ্ছে, উন্নয়নের নামে যেসব অনিয়ম হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করা। সেটি আমরা করছি কি না বা নির্ভয়ে এসব প্রশ্ন তুলতে পারছি কি না, তার উপরে নির্ভর করে আমরা আসলে কী ধরনের উন্নয়ন সাংবাদিকতা করছি।

একজন নারী সেলাই শিখে স্বাবলম্বী হলে, আলুর বাম্পার ফলন হলে, ব্রি নতুন কোনো জাতের ধান উদ্ভাবন করলে সেটি অবশ্যই উন্নয়ন সংবাদ। কিন্তু তার চেয়ে বড় উন্নয়ন সংবাদ, উন্নয়ন নিয়ে যে মিথ ও ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখা হয়, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করা। সেই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে জড়িত স্বাধীন সাংবাদিকতা। উন্নয়ন ইস্যুতে গণমাধ্যম যদি সঠিক প্রশ্নটি করতে না পারে, তাহলে ধরে নিতে হবে আমাদের সাংবাদিকতা পরাধীন এবং কিছু লোকের উন্নয়ন হলেও আখেরে জনগণের পয়সার হিসাব আমরা নিতে পারছি না।  জনগণের পয়সার হিসাব নিতে পারাটাই সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সাংবাদিকতা।

আবার উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়, পাশাপাশি এর সাথে নানারকম আর্থ-সামাজিক নানা বিষয় জড়িত, সেগুলোও খেয়াল করা। সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ের ফলে কারা লাভবান হবেন এবং বিশেষ কোনো শ্রেণিপেশার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কি-না, সে বিষয় তুলে ধরা।

উন্নয়ন সাংবাদিকতায় প্রকল্পের বা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের ব্যাপারে জনগণের মতামত যেমন গুরুত্ব পায়, তেমনি এর ভালো দিকগুলোও জনগণকেও বোঝাতে হয় । এ ধরনের রিপোর্ট হতে হয় বিশ্লেষণধর্মী এবং অনুসন্ধানমূলক। ফলে এক্ষেত্রে প্রতিবেদককে গবেষকের ভূমিকা পালন করতে হয়। গৃহীত প্রকল্প বা কর্মকা-ের প্রস্তাবিত বাজেট, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের খুঁটিনাটি দিকগুলো বিশ্লেষণাত্মকভাবে তুলে ধরতে হয়।

নতুন কোনো প্রযুক্তি বা পন্থা অবলম্বন করে কেউ যদি নিজের ভাগ্যন্নোয়ন করে থাকেন, সেক্ষেত্রে অন্যদের উৎসাহ দিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার গল্প প্রচার ও প্রকাশ করাও একধরনের উন্নয়ন সাংবাদিকতা। সাধারণ মানুষকে এটা বোঝাতে হয় যে, উন্নয়ন কোনো দল বা বিশেষ গোষ্ঠীর দানের ফসল নয়; বরং প্রত্যেকের কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হয় নিজেদেরই।

আমাদের দেশে ফি বছর হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়। কিন্তু সেই উন্নয়নের উল্টোপিঠ প্রকাশ্য হয় বর্ষার  মৌসুমে। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় রাজধানী, বিশাল নদীতে পরিণত হয় বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম। বৃষ্টি মানেই পুরো ঢাকার রাজপথ পরিণত হয় গাড়ি পার্কিংয়ে। তখন শুধু বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের সেই গানই মনে আসে, ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে গাড়ি চলে না।’ তো গাড়িই যদি রাস্তায় না চলে, তাহলে এত এত পয়সা খরচ কেন ওই ফ্লাইওভার, কেন চার লেন, কেন হাজার কোটি টাকার সেতু? উন্নয়ন সাংবাদিকতা মানে এই ‘কেন’র উত্তর খোঁজা।

হাওরের মাছ খেয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলি। হাওরের দিগন্তবিস্তৃৃত ফসলের মাঠ দেখে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ছবি আঁকি। কিন্তু সেই হাওরের বাঁধ ভেঙে যখন লাখো মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়, বিষাক্ত অ্যামোনিয়ায় মাছ মওে ভেসে ওঠে, তখন আমাদের প্রশ্ন করতে হয়, জনগণের পয়সায় উন্নয়নের নামে যে বাঁধ নির্মাণ করা হলো, সেটি কেন ভেঙে গেলো? বাঁধ যদি অতিবৃষ্টি কিংবা পানির তোড়ে ভেঙেই যাবে, তাহলে সেই বাঁধ নির্মাণের অর্থ কী? রোদ ঠেকানোর জন্য নিশ্চয়ই বাঁধ দেয়া হয় না। মানুষের জানমাল রক্ষা তথা তার আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য তার করের পয়সায় কিংবা কখনো বিদেশিদের পয়সায় অথবা ঋণে যে বাঁধ নির্মাণ করা হলো, সেই বাঁধ কেন মানুষের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার বদলে মানুষের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিলো? যারা সেই বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের জবাবদিহিতা কোথায়? এই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার নামই উন্নয়ন সাংবাদিকতা।

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে। গরিব মানুষের পকেটেও মোবাইল ফোন। সামাজিক  যোগাযোগ বেড়েছে। মানুষ স্মার্ট হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই তথ্যপ্রযুক্তির বিবিধ পন্থায় অপব্যবহারও হচ্ছে। একদিকে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন তথা রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচলে তথ্যপ্রযুক্তি যেমন বিশাল ভূমিকা রাখছে, পক্ষান্তরে এর অপব্যবহারে মানুষের জীবনও বিপন্ন হচ্ছে। ফলে এটি হচ্ছে উন্নয়নের উল্টোপিঠ। সেই উল্টোপিঠের খবরও আমাদের রাখতে হয়।

উন্নয়ন সাংবাদিকতা মানে শুধু আলু পটলের বাম্পার ফলন আর নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হওয়ার গল্প নয়; বরং উন্নয়ন সাংবাদিকতা মানে উন্নয়নসম্পর্কিত যাবতীয় ক্রিটিক্যাল বা জটিল প্রশ্নসমূহের অবতারণা করা এবং সেই অর্থে উন্নয়ন সাংবাদিকতা অনুসন্ধানী এবং অপরাধ সাংবাদিকতাও বটে।

No comments:

Post a Comment