আমীন আল রশীদ
আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘একজন বুদ্ধিজীবীকে
চিন্তা করতে হয়। কিন্তু চিন্তার বদলে তিনি যদি চিন্তা করার ভান করেন পরিণতি ভয়ংকর হতে
বাধ্য।’
আমাদের দেশে মোটা দাগে পাঁচ ধরনের বুদ্ধিজীবীর দেখা মেলে। কিছু বুদ্ধিজীবী
প্রকৃত অর্থেই বুদ্ধিজীবী-যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানেন বোঝেন ভাবেন এবং প্রয়োজন মতো
এসব বিষয়ে পরামর্শও দেন। এক্ষেত্রে কথাটা কার পক্ষে গেলো বা কার বিপক্ষে-কে গোস্বা
করলো বা কে খুশি হলো, কে দালাল বললো বা বললো না-এসবের ধার ধারেন না। তবে এই সংখ্যাটা
জ্যামিতিক হারে কমছে।
দ্বিতীয় গোত্রে আছেন কিছু কনফিউজড বা সংশয়বাদী বুদ্ধিজীবী।তারা জানেন
বোঝেন কিন্তু কী বলতে হবে বা কী বললে কে মাইন্ড করবে এবং তার পরিণাম কী হবে, তা নিয়ে
ভাবতে ভাবতে ডায়াবেটিক বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এই সংখ্যাটাও কম নয়।
তৃতীয় কাতারে আছেন দলবাজ বুদ্ধিজীবী। এরা সব সরকারের আমলেই থাকেন এবং
এরা চিহ্নিত। তিনি অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, নাট্যকার, অভিনেতা যাই হোন না কেন, তাকে
সবাই অমুক দলের লোক বলে চেনে এবং যখন তাদের সমর্থিত দল ক্ষমতায় থাকে তখন তারা বরং নিজেদের
ওই দলের বুদ্ধিজীবী পরিচয়ে সাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপদ বোধ করেন। তবে যখন তাদের দল ক্ষমতায়
থাকে না তখন তারা কিছুটা ব্যালান্স করে চলার চেষ্টা করেন এবং সতর্ক থাকেন যাতে কথাবার্তা
বা লেখালেখিতে ক্ষমতাবানরা বেশি গোস্বা না হয়। কেউ কেউ অবশ্য বেশ সাহসিকতারও পরিচয়
দেন। সেই সংখ্যাও নগণ্য।
চতুর্থ গোত্রে আছেন নির্জ্ঞান, মূর্খ বা বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবী। এদের
সংখ্যা টেলিভিশনের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন আমরা টেলিভিশনে যত
আলোচনা অনুষ্ঠান বা টকশো দেখি, তার একটা বড় অংশজুড়েই থাকে এই নির্মগজ বুদ্ধিজীবীদের
উপস্থিতি। যেমন সমাজবিজ্ঞান নিয়ে দু চার লাইন পড়েই সমাজবিজ্ঞানী, নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে
একটু আধটু জানলেই নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সংবিধান নিয়ে চার লাইন পড়েই সংবিধানবিশেষজ্ঞ
ইত্যাদি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবীরা এমন সব কথা বলেন, এমন
সব তথ্য দেন যা অনেক সময়ই সর্বৈব ভুল। এদের কেউ কেউ নির্দিষ্ট ফরম্যাটের বাইরে কিছু
বলার যোগ্যতা রাখেন না। কেউ কেউ দু চার লাইন রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে নিজেকে অনেক
পণ্ডিত বলে জাহিরের চেষ্টা করেন। এই বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবীদের নেটওয়ার্কিং অত্যন্ত শক্তিশালী।
ফলে অনেক টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য
হয়।
পঞ্চম কাতারে আছেন জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবী। তাদের সংখ্যাও ক্রমবর্ধিষ্ণু।
এরা যা জানেন তা জানান না। যা বিশ্বাস করেন তা বলেন না। যা বলেন তা করেন না। এদের আধিপত্য
টেলিভিশনের টকশোতে। এরা প্রকৃত সত্য আড়াল করে বিশেষ কাউকে খুশি রাখতে চান। এদের চোখে
মুখেই মিথ্যার ছাপ স্পষ্ট থাকে। এরা যখন কথা বলেন, দেখেই বোঝা যায় এরা ধুরন্দর। যদিও
এরা নিজেদের ফেরেশেতার সমতুল্য করেন। এদের সম্পর্কে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন,
‘বুদ্ধিজীবীর রক্তে
স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ।’
বুদ্ধিজীবীদের বলা হয় সমাজের আলোকবর্তিকা। তারা যখন সচেতনভাবে অপরাধ
করেন, তার দায় পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের ঘাড়েই পড়ে। তার মাশুল দিতে হয় পুরো জনগোষ্ঠীকে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘যে দেশে গণমাধ্যম
স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না’- তেমনি যে দেশের
বুদ্ধিজীবীরা সচেতনভাবে অপরাধ করেন বা করতে বাধ্য হন কিংবা স্বাধীন নন, সে দেশে গণতন্ত্র
বিকশিত হবার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, বুদ্ধিজীবীরা যদি স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত ব্যক্ত
করতে না পারেন, তাহলে ক্ষমতাসীনরা কখনোই তাদের ভুলগুলো জানতে পারবে না। সে কারণে বুদ্ধিজীবীদের
অনেক সময় গণতন্ত্রের আয়না বলা হয়। অর্থাৎ একটি সমাজ ও রাষ্ট্র সঠিক পথে এগোচ্ছে কি
না, সেটি দেখাবার দায়িত্ব তাদের।
২.
বলা হয়, একটি সমাজ বা রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সেই সমাজে গণতন্ত্রের
চর্চা আসলেই কতটুকু আছে, তার প্রধান মানদণ্ড হচ্ছে সেখানে ভিন্ন মতের চর্চা কতটুকু
আছে? সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের মূল দায়িত্বটিই হলো তারা ভিন্ন মতের সৌন্দর্য দেখাবেন
এবং ক্ষমতাসীনরা বুদ্ধিজীবীদের সেই ভিন্ন মত আমলে নিয়ে যতটুকু সম্ভব গ্রহণ করবেন। গ্রহণ
না করলেও বুদ্ধিজীবীদের অন্তত গালাগাল করবেন না।
কিন্তু আমরা বছর কয়েক ধরেই দেখছি, গালাগালি আর হুমকি ধমকির ভয়ে কিংবা
কখনো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এবং কিছু নগদ সুবিধার লোভে বুদ্ধিজীবীরা মানে সুশীল সমাজের
লোকেরা এমন কোনো বিষয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন না, যা সরকারের কোনো বড় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ
করে। কিছু লেখক-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাঝে মধ্যে কথা বলেন টকশোতে, সংবাদপত্রে
লেখেন-কিন্তু অনেক সময়ই তাদের একটা ভয় বা শঙ্কার ভেতরে থাকতে হয়। সব সময় যে সরকারের
তরফে তাদের ওপর আক্রমণ আসে এমন নয়। কিন্তু দেখা যায়, যারা কথা বলেন না লেখেন, তাদের
শুভাকাঙ্ক্ষীরাই সব সময় সব বিষয়ে খোলামেলা বলা বা লেখায় নিরুৎসাহিত করেন। বলেন, ‘সময় ভালো না’। এই সময় ভালো
না অজুহাতে অনেক সময় নাগরিক সমাজ বা সুশীল সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ
ইস্যুতে নিরব থাকেন অথবা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, যা আসলে কোনো পূর্ণাঙ্গ
অর্থই তৈরি করে না। ফলে আমরা একদিকে বলি আমরা খুব গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে
বুদ্ধিজীবীরা কোনো সমালোচনা করলে তার গায়ে বিশেষ কোনো দলের বা গোষ্ঠীর সিল লাগিয়ে দিই।
ফলে এই সিল খাওয়ার ভয়েও অনেক সময় নাগরিক সমাজের লোকেরা চুপ থাকেন।

No comments:
Post a Comment