Thursday, September 28, 2017

বিকল্প গণমাধ্যমে দায়বদ্ধতার প্রশ্ন


আমীন আল রশীদ
সিলেটের শিশু রাজন হত্যা মামলার পুরো বিচারকাজ শেষ হয়েছে মাত্র ১৭ কার্যদিবসে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।দেশের আদালতগুলোয় যেখানে প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন, সেখানে মাত্র ১৭ দিনে এরকম একটি চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারকাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছে সামাজিক চাপের কারণে। আর এই চাপটি এসেছে বিকল্প গণমাধ্যম, আরও পরিস্কার করে বললে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণজমায়েত, যেখানে রাজনৈতিক দল, ধর্ম, বয়স,পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষ একত্র হয়েছিলেন শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, সেটিরও অনুঘটক এই ফেসবুক বা বিকল্প গণমাধ্যম।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত মূলধারার গণমাধ্যমের বাইরে যেসব মাধ্যমে নাগরিকরা নিজেদের প্রয়োজনে নানা তথ্যের আদান-প্রদান করেন, সেটিকেই আমরা বিকল্প গণমাধ্যম বলতে পারি।কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের কেন বিকল্প বা অলটারনেটিভ প্রয়োজন বা আদৌ প্রয়োজন কি না?
সহজ জবাব, যদি মূলধারা বা প্রচলিত জিনিসটি গণমানুষের বা সব শ্রেণিপেশা ও রাষ্ট্রের সব অংশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, তাহলে বিকল্পের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মূলধারা যখন সকলের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয় বা যখন রাজনৈতিক প্রভাব, সরকারের নিয়ন্ত্রণ, বিজ্ঞাপনদাতা অর্থাৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রণ, প্রতিষ্ঠান মালিকের ব্যক্তি  ও ব্যবসায়িক স্বার্থ ইত্যাদি কারণে মূলধারার গণমাধ্যম সমাজের সব শ্রেণিপেশা ও সব অংশের মানুষকে সমানভাবে উপস্থাপন করতে  ব্যর্থ হয়, তখনই আসে বিকল্প গণমাধ্যমের ভাবনা। তখনই সমাজের বঞ্চিত জনগোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে অলটারনেটিভ বা বিকল্পের সন্ধান করে।
ধরা যাক কমিউনিটি রেডিও। কমিউনিটি রেডিওর শ্লোগান হচ্ছে কণ্ঠহীনের কণ্ঠস্বর। তার মানে মূলধারার গণমাধ্যমে যেসব মানুষের কণ্ঠ শোনা যায় না, যাদের কথা বলা হয় না, তাদের জন্য কমিউনিটি রেডিও। মূলধারার গণমাধ্যম যদি তৃণমূলের মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করত, তাহলে কমিউনিটি রেডিওর প্রয়োজন হত না।
২.
ধরা যাক ফেসবুক। এটি মূলত সামাজিক যোগাযোগ্যমাধ্যম।কিন্তু ক্রমেই এটি এখন গণমাধ্যমের চরিত্র পেয়েছে।অনেক সময় মূলধারার গণমাধ্যমের অনেক আগেই মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে খবর জেনে যায়। কারণ স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেট সহজলভ্য হতে থাকায় এখন যখন যেখানে যা কিছুই ঘটুক না কেন, মানুষ তৎক্ষণাৎ তা ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। কখনো স্ট্যাটাস, কখনো ছবি, কখনো ভিডিও।
রাজনকে পিটিয়ে হত্যার ছবি প্রথমে ফেসবুকেই প্রকাশ পায় এবং সেই ছবি পরবর্তীতে মূলধারার গণমাধ্যম যেমন টেলিভিশন ও সংবাদপত্র প্রকাশ করে। যার ফলে সারা দেশেই ওই নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে গণজাগরণ শুরু হয় এবং সামাজিক এই চাপই দ্রুততম সময়ে মামলার বিচারকাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের বাধ্য করে।
ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একদিকে যেমন সামাজিক যোগাযোগের একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং যোগাযোগের সীমানা বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি ফেসবুক এরইমধ্যে একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রেশার-গ্রুপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কখনো কখনো এই শক্তি রাজনৈতিক শক্তির মতোই কার্যকর।
৩.
আসা যাক ব্লগিং প্রসঙ্গে। ইন্টারনেটে যেকোনো লেখালেখিকেই ব্লগিং বলা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ব্লগিং শব্দটি বেশি পরিচিতি পেয়েছে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালীন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের পর।
ব্লগে অনেকেই সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখি করেন। এখানে অনেক তথ্যমূলক লেখা যেমন থাকে, তেমনি অনেক লেখা সমাজের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, কখনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়, আবার কখনো সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়-এমন অভিযোগও মেলে। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ব্লগে লেখালেখিকে ঠিক সাংবাদিকতা বলা যাবে কি না।
ফেসবুক ও ব্লগে যেহেতু সরাসরি কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেই,যেহেতু এখানে সরকার সরকারি নাক গলায় না, যেহেতু এখানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কম, তাই নাগরিকরা নিজের প্রতিক্রিয়া কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়াই এখানে প্রকাশের সুযোগ পান। যে কারণে অনেক সত্য বিষয়ের সাথে সাথে বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা ও ভুল তথ্যও হামেশা প্রকাশিত হয়।এখানেই মূলধারার গণমাধ্যমের সাথে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা বিকল্প গণমাধ্যমের তফাৎ।
বলা হয়ে থাকে, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মুক্তচিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অনেক সহজতর হয়েছে। কিন্তু মুক্তচিন্তা আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে অন্যের ব্যক্তিগত জানালায় টোকা দেয়া, অন্যকে হেয় করা, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া, সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়া-ইত্যাদিও ঘটছে। ফলে মূলধারার গণমাধ্যমের সাথে এর প্রধান পার্থক্য রচিত হচ্ছে দায়বদ্ধতায়, সম্পাদনায়।
মূলধারার গণমাধ্যমে একজন সাংবাদিক যা ইচ্ছে তাই লেখার বা বলার সুযোগ পান না। তাকে একটা নির্দিষ্ট গেট পেরিয়ে অর্থাৎ সম্পাদনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটি লেখা একাধিক হাত ঘুরে পাঠক ও দর্শক-শ্রোতার কাছে যায়। ফলে সেখানে যদি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া বা সাম্প্রদায়িক উসকানি তৈরির মতো কিছু থাকে, সেটি বাদ দেয়ার সুযোগ থাকে; সোশ্যাল মিডিয়া বা বিকল্প গণমাধ্যমে এর সুযোগ নেই।
তারপরও এই বিকল্প গণমাধ্যমই জনপ্রিয় হচ্ছে এবং কখনো কখনো এটি মূলধারার গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জ করছে। এবং এটি এ কারণে সম্ভব হচ্ছে যে, মূলধারার গণমাধ্যম সমাজের সব মানুষের কথা বলে না। সব জায়গায় পৌঁছে না। অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়।  
আমরা কমিউনিটি রেডিওকে যদি বিকল্প গণমাধ্যম বলি তাহলে দেখব, সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুকের সঙ্গে এর একটি মৌলিক তফাৎ রয়েছে। আর তা হলো, কমিউনিটি রেডিওগুলো কমিউনিটির মানুষের দ্বারা পরিচালিত হলেও, মূলধারার গণমাধ্যমের মতোই এর একটি পরিচালন বোর্ড রয়েছে,এর একটি সম্পাদনা বিভাগ রয়েছে এবং এটি মূলধারার গণমাধ্যমের মতোই অর্থ আয়ের চেষ্টা করে। তারপরও এটি বিকল্প গণমাধ্যম এ কারণে যে, এই মাধ্যমটি তৈরি হয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা আর ব্যর্থতার কারণে।
৪.
সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা প্রত্যয়টিও বহুল শ্রুত। আমরা যে মূলধারার গণমাধ্যমের কথা বলি, তারাও এই ধরনের সাংবাদিকতাকে উৎসাহ দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং এনটিভি অনলাইনের কথা বলতে পারি।
বিডিনিউজ তাদের ওয়েবসাইটে সিটিজেন জার্নালিজম নামে একটি আলাদা পেজ রেখেছে যেখানে পাঠকরা নানা বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। বিভিন্ন সংবাদ ছবিসহও তারা সেখানে দিচ্ছেন।
একইভাবে এনটিভি অনলাইনও আমিই সাংবাদিক নামে নাগরিকদের জন্য যে পৃষ্ঠা বরাদ্দ রেখেছে সেখানে সিরিয়াস অনেক খবর যেমন রয়েছে, তেমনি ভ্রমণ কাহিনী, বিনোদনের খবরও রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, মূলধারার গণমাধ্যম কেন এই বিকল্প সাংবাদিকতাকে উৎসাহ দিচ্ছে? এর দুটি কারণ থাকতে পারে; প্রথমত এর মধ্য দিয়ে কর্তৃপক্ষ চায় পাঠকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বাড়াতে, দ্বিতীয়ত এমন অনেক খবর বা তথ্য অনেক সময় পাঠকদের তরফে আসে যা অনেক সময় তাদের বেতনভুক্ত সাংবাদিকদের কাছে থাকে না। কারণ পৃথিবীর সব দেশে এমনকি দেশের সবগুলো উপজেলায়ও সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে দেশের বাইরে এবং প্রত্যন্ত এলাকা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরও এই সিটিজেন জার্নালিস্টদের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব।
৫.
তবে এই বিকল্প সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ একটাই; আর তা হলো বিশ্বাসযোগ্যতা। একজন বেতনভুক্ত সাংবাদিক চাইলেই যেকোনো কিছু লিখতে পারেন না। তাকে বারবার ক্রসচেক করতে হয়। খবর বা তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হয় তথ্যের সত্যতা, যথার্থতা; সেখানে বিকল্প গণমাধ্যমের এই দায়বদ্ধতা কম। তাই মূলধারার গণমাধ্যমের মতো এই বিকল্প গণমাধ্যমে যারা লেখেন বা ছবি আপলোড করেন, তারা যদি যেকোনো তথ্যের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেন, সেটি সমোজের মানুষের মধ্যে তথ্যশূন্যতা পূরণে একটা বড় ভূমিকা রাখবে।
ফটোশপে এডিট করার অং সাং সুচির হিজাব পরা ছবি ফেসবুকে দেখেই আপনি যদি লিখে ফেলেন সুচি মুসলমান হয়ে গেছেন বা কোনো একটা কথা শুনেই সেটির সত্যাসত্য যাচাই না করে সিটিজেন জার্নালিজমের নামে আপলোড করে দেন, সেটি অনেক ভয়ঙ্কর এবং সেটি নাগরিকের তথ্যশূন্যতা পূরণের বদলে তথ্যবিভ্রান্তি তৈরি করবে; যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।

No comments:

Post a Comment