আমীন আল রশীদ
‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের
অধিকারী’; সংবিধানের এই
২৭ অনুচ্ছেদ মানলে এবং এর বাস্তবায়ন হলে আইনের শাসন নিয়ে আর কোনো আলোচনা বা বিতর্কের
প্রয়োজন হয় না। কিন্তু শাসনতন্ত্রে এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় আমাদের সবচেয়ে বেশি কথাবার্তা
বলতে হয় এই আইনের শাসন প্রশ্নেই।
স্বাধীনতার ৪৬ বছরে বাংলাদেশের অর্জন নিশ্চয়ই অনেক। একসময়ের তলাবিহীন
ঝুড়ি এখন অর্থনীতিতে বিশ্বের বিস্ময়। নারী উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মাতৃমৃত্যু
হার কমানো, স্যানিটেশন ইত্যাদি ইস্যুতে বাংলাদেশকে এখন রোলমডেল বলে স্বীকার করে বিশ্ব।
কিন্তু তারপরও যে জায়গাটি নিয়ে আমাদের অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি, অবশ্যই তার নাম আইনের
শাসন।
এখনও আমরা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে নিষ্কলুষ, রাজনীতিমুক্ত এবং গরিববান্ধব
করে গড়ে তুলতে পারিনি। এখনও অসংখ্য মানুষ বিনা বিচারে কারাভোগ করছে, রাজনৈতিক পরিচয়ের
কারণে অবিচারের শিকার হচ্ছে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে অনেক সময়ই বিচার ব্যবস্থাকে
প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠে। ফলে রাষ্ট্রের খোদ প্রধান বিচারপতিকেও বলতে হয়, ‘আমরা এখনও পুরোপুরি
আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারিনি।’ এজন্য অবশ্য তার অভিযোগের তীর রাষ্ট্রের
সবচেয়ে প্রভাবশালী স্তম্ভ সরকার বা নির্বাহী বিভাগের দিকেই।
বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বলছেন, সরকার চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে
চলুক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারকই যখন বলেন যে, দেশে আইনের শাসন নেই বা সরকার বিচার
বিভাগের কণ্ঠরোধ করতে চাইছে-তখন বিষয়টি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে।
প্রধান বিচারপতির এই ক্ষোভের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।তবে সাম্প্রতিক
কারণ অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ-সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশে
বিলম্ব। এই গেজেট প্রকাশে সরকার বারবার সময় নিচ্ছে এমনকি এর ব্যাখ্যা দিতে গত বছরের
৮ ডিসেম্বর দুজন সচিব আপিল বিভাগ তলবও করেছিলেন।এই ইস্যুতে ১৪ মার্চ ক্ষোভ প্রকাশ করে
প্রধান বিচারপতি বলেন,বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।সরকার বিচার বিভাগের সাথে
বিমাতাসুলভ আচরণ করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আপিলে সরকার বারবার সময় চাইলে প্রধান বিচারপতি
অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেছেন, মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবন বা গণভবনের
দূরত্ব কয়েক লাখ কিলোমিটার! ফাইল চলাচলে সময় লাগে আড়াই বছর।
প্রধান বিচারপতির অভিযোগ, ‘প্রশাসন কোনো
দিনই চায়নি, এখনও চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক। প্রশাসনের যারা উচ্চপর্যায়ে
আছেন, তাদের পরিচালনা করেন কিছু আমলা, কিছু লোক পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সত্য জিনিসটি তাদের
কর্মক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয় না। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা মনে করে বিচার বিভাগ তাদের
প্রতিপক্ষ। এটি তাদের ভুল ধারণা।’
তবে প্রধান বিচারপতির এসব বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের অবস্থান
হলো, প্রধান বিচারপতির কোনো ক্ষোভ থাকলে তিনি তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
আইনমন্ত্রীর ভাষ্য, প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের কোনো দেশের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে
এত কথা বলেন না। প্রধান বিচারপতিরা বিচার বা আইনসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়া অন্য বিষয় নিয়েও
কথা বলেন না।
এ বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচার বিভাগকে
ইঙ্গিত করে বলেছেন, কারো ক্ষমতাই কম নয়। সুতরাং সবার সমন্বয় ও সমঝোতার মাধ্যমে কাজ
করা উচিত। আইন প্রণয়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়া স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ করেন
যাতে আদালত চট করে কোনো আইন বাতিল না করেন।
মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভের মধ্যে প্রয়োগিক ক্ষেত্রে
নির্বাহী বিভাগ সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। কেননা তারা একইসঙ্গে আইন বিভাগ বা সংসদও নিয়ন্ত্রণ
করে। বাকি থাকে বিচার বিভাগ এবং বিচার বিভাগ বা আদালতকে বলা হয় বাকি দুই বিভাগের উপর
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাকারী। কেননা, আইন বিভাগ বা সংসদ যদি এমন কোনো আইন করে যা নাগরিকের
মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বা সংবিধান অথবা অন্য কোনো আইনের সাথে সাংঘর্ষিক,তাহলে সেটি
বাতিলের ক্ষমতা আদালতের রয়েছে।আবার কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে তাকে
অপসারণের ক্ষমতাও রয়েছে সংসদের। কিন্তু সরকার বা নির্বাহী বিভাগের প্রতি বিচার বিভাগের
ক্ষোভের এটিও একটি কারণ। কেননা সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারকদের বিচারের
জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান বাতিল করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আলোকে
বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করতে সংবিধানে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে,সেটিকে
আদালত অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন।ফলে দেখা যাচ্ছে, নানা ইস্যুতেই রাষ্ট্রের প্রধানতম দুটি
স্তম্ভের (আইন ও নির্বাহী) সাথে বিচার বিভাগের
একটা মতবিরোধ বা সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজমান-যা প্রকারান্তরে আইনের শাসনের পথকে বাধাগ্রস্ত
করে।
যদিও আইনের শাসন প্রশ্নে প্রধান বিচারপতির এসব মন্তব্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা সংসদের বলেছেন, ‘আমি জানি না আমাদের চিফ জাস্টিস
কীভাবে বললেন, আইনের শাসন নেই? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই?’ জিয়া অরফানেজ
ট্রাস্ট নিয়ে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একজন নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলায় ১৪০ দিন
সময় চায় আর সেটা দেওয়া হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলেই তো এই সময়টা দিতে পারছে।’ শেখ হাসিনা বলেন,
‘কথায় কথায় রিট।
একই মামলায় যদি ৪০-৫০ বার রিট হয় আর যদি সেই রিট নিষ্পন্ন হয়, তাহলে স্বাধীনতা নেই
কীভাবে?
আমরা প্রধান বিচারপতির আরেকটা বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে পারি। তিনি বলেছেন,
দেশে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই যথেষ্ট নয়,সুশাসনও দরকার। তিনি মনে করেন,অনেক দেশের মাথাপিছু
আয় অনেক বেশি হলেও তারা উন্নত দেশের মর্যাদা পায় না। এর সঙ্গে আরও অনেক সূচক জড়িত।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনের শাসন।
সুতরাং রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য সরকার বা নির্বাহী বিভাগ যাবতীয় কার্যক্রম
হাতে নেবে, যোগাযোগ, চিকিৎসা,শিক্ষা, পরিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিবিধ প্রকল্প গৃহীত
হবে, এটা যেমন স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত, তেমনি বিচার বিভাগকেও তার মতো করে চলতে দেবে
এবং বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করবে না, সেটি আরও বেশি
প্রত্যাশিত।
যদিও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলো অনেক সময়ই চায় না বিচার
বিভাগ স্বাধীনভাবে চলুক। কারণ তাকে অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নিতে হয় আদালতের মাধ্যমে।
কিন্তু আদালত যদি নিরপেক্ষ থাকে, সেক্ষেত্রে সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন
হয়ে পড়ে। যে কারণে প্লেটেো বলেছেন, ‘শাসক ন্যায়পরায়ণ
হলে আইনের শাসন নিষ্প্রয়োজন’। অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ শাসক মানেই তিনি তার
রাষ্ট্রে আইনের শাসন নিশ্চিত করবেন।ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ
বিচার ব্যবস্থা যেমন জরুরি, তেমনি এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটা
সরকারের বা শাসকের। অর্থাৎ শাসক যদি চান যে, তার দেশে আইনের শাসন থাকবে, শাসক যদি ভিন্নমত
দমনের জন্য এমন কোনো আইন পাস না করেন যা সংবিধান ও অন্যান্য আইনের সাথে সাংঘর্ষিক,
শাসক যদি মনে করেন যে ভিন্নমতই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেবে এবং রাষ্ট্র ও উন্নয়নের প্রশ্নে
সবার মতামত তিনি গ্রহণ করবেন, তাহলে সেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার একটা পরিবেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই
তৈরি হয়।
আমরা উল্লেখ করতে পারি প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী ও অ্যাকাডেমিক স্যার
উইলিয়াম আইভর জেনিংসের (১০৯০৩-১৯৬৫) সেই বিখ্যাত উক্তি; তিনি বলেছেন: ‘প্রকৃত অর্থে
আইনের শাসন বলতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা তথা সাংবিধানিক সরকারকে বোঝায়, যেখানে
সরকারের সমালোচনা শুধু অনুমোদিতই নয়, বরং একটি উত্তম গুণ; যেখানে রাজনীতি শুধু গ্রহণযোগ্য
নয় বরং উৎসাহিত করা হয়।’

No comments:
Post a Comment