আমীন আল রশীদ
‘দুনিয়াটা নানারকম মালে ভরে গেছে; আর যেসব মাল উত্তর
থেকে দক্ষিণ, পুব থেকে পশ্চিমে সবচেয়ে বেশি চলছে, তার মধ্যে এক নম্বর মাল হচ্ছে গণতন্ত্র;এর
মতো আর কোনো মাল নেই; ধর্মকর্ম, হ্যামবার্গার, প্রেম, ফিশ এন্ড চিপস, কাম, কোকাকোলা,
বিয়ার, প্রিন্সেস ডায়না আর রাবারও এত জনপ্রিয় নয়।’
গণতন্ত্র নিয়ে পণ্ডিতরা নানারকম তত্ত্ব ও বক্তব্য দিলেও বিষয়টি নিয়ে
প্রয়াত লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের মতো এরকম রসিকতা আর কেউ করেছেন বলে মনে হয় না।তবে
এটা ঠিক, টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক নিয়ে যেরকম হৈচৈ আর তর্ক-বিতর্ক
হয়,গণতন্ত্রের সূচক নিয়ে ততটা হয় না।
গত ২৫ জানুয়ারি বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশের একদিন পরই যুক্তরাজ্যের
প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট যে গণতন্ত্রের সূচক প্রকাশ করেছে,সেখানে দেখা যাচ্ছে
দুর্নীতির ধারণাসূচকে যেসব দেশ এগিয়ে, অর্থাৎ দুর্নীতিমুক্ত বা একবারেই কম দুর্নীতির
দেশ, সেসব দেশ গণতন্ত্রের সূচকেও এগিয়ে। আবার যেসব দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত, সেসব দেশে গণতন্ত্র
অনুপস্থিত অথবা গণতন্ত্র খুবই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে ব্যতিক্রম
যুক্তরাষ্ট্র। তুলনামূলক কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইকোনমিস্টের সূচক অনুযায়ী
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি হতাশাজনক।প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ব্যাপারে
বলা হয়েছে, এখানে গণতন্ত্রের পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। গতবার যেখানে ছিল সেখানেই
আছে।
বিশ্বের ১৬৭ দেশের গণতন্ত্র সূচকে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম।এবার
তার স্কোর ৫ দশমিক ৭৩। গতবারও এই স্কোর ছিল। অর্থাৎ গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি
বা অবনতি কোনোটাই হয়নি। তালিকায় পাকিস্তান রয়েছে বাংলাদেশের পেছনে। তবে বাংলাদেশের
ওপরে রয়েছে ভারত। ইকোনমিস্টের ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলছে,গত বছর গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে
৫৭টি দেশে। এ বছরকে গণতান্ত্রিক মন্দার বছর হিসেবেও উল্লেখ করেছে ইকোনমিস্ট।
গণতন্ত্রের এই সূচক প্রকাশের একদিন আগেই বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল বা টিআই যে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে,
এবারও দুর্নীতিমুক্ত বা কম দুর্নীতির তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইডেন।
গণতন্ত্রের সূচকেও এই দেশগুলো শীর্ষে। তাহলে কি এটা বলা যায় যে, গণতন্ত্র থাকলে সেখানে
দুর্নীতি কম হয়?
উল্লেখ্য, ইকোনমিস্ট যেদিন গণতন্ত্রের এই সূচক প্রকাশ করে, সেদিন ঢাকার
বাইরে এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খান বলেছেন, যে গণতন্ত্রের মানে মানুষ
পুড়িয়ে মারা, সেই গণতন্ত্র দেশের মানুষ চায় না। মানুষ চায় উন্নয়নের গণতন্ত্র।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের
নেতারা এই তত্ত্বটি বলে বেড়াচ্ছেন যে, আগে উন্নয়ন তারপর গণতন্ত্র। তাদের কেউ কেউ আইয়ূব
খানের বেসিক ডেমোক্রেসি (মৌলিক গণতন্ত্র) এবং মালয়েশিয়ার ‘সীমিত গণতন্ত্রের’ কথাও বলেন।বাস্তবতা
হলো, কোনো দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র থাকলে সেখানে উন্নয়ন এমনিতেই হবে। কারণ গণতন্ত্র
থাকলে সেখানে ভিন্ন মত থাকবে, সেখানে যেকোনো বিষয়ে মানুষের মুক্তভাবে কথা বলার পরিবেশ
থাকবে, যেকোনো বিষয়ে নাগরিকের মত প্রকাশের সুযোগ থাকবে, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা
থাকবে। আর এগুলো নিশ্চিত হলে উন্নয়ন হবে। অর্থাৎ গণতন্ত্র হচ্ছে উন্নয়নের সহায়ক শক্তি-বিকল্প
নয়।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ মোটামুটি একই জায়গায়
ঘুরপাক খাচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪। এবার
১৩ তম। এর আগে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় কয়েকবার প্রথম হয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সেই
শীর্ষস্থান থেকে ১৪ নম্বরে চলে যাওয়ায় খুব বেশি আশাবাদী হবার কিছু আছে বলে মনে হয় না।
কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি আগের পর্যায়েই রয়ে গেছে বেলে ধারণা করা যায়।
যেসব কারণে বাংলাদেশে দুর্নীতির সূচকে উন্নতি করতে পারছে না, তার মধ্যে
রয়েছে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বিরোধী উদ্যোগের প্রয়োগ ও
চর্চার ঘাটতি। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের
(দুদক) কার্যকারিতা ও স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস যেমন অব্যাহত রয়েছে তেমনি দুদকের
নিজস্ব সক্রিয়তা, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতার ঘাটতায়ও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করা হয়।সরকারি সেবাদানকারী
প্রতিষ্ঠান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে জবাবদিহিতার ঘাটতিও এর একটি বড় কারণ।
তবে বাংলাদেশে যে দুর্নীতি কমেনি বা গণতন্ত্রের চর্চা যে বাড়েনি বরং রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা কমছে-তা
বোঝার জন্য টিআই বা ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ
সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের জীবন চর্চা থেকেই বুঝতে পারে দেশের দুর্নীতির শেকড় কত গভীরে
এবং কী ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা এখানে হয়।
আক্ষরিক অর্থে একশো ভাগ গণতন্ত্র পৃথিবীর হাতেগোণা কিছু দেশ ছাড়া কোথাও
নেই এবং এটি নিশ্চিত করা বেশ কঠিনও। কিন্তু দুর্নীতি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব
যদি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। একশো ভাগ গণতন্ত্র না থাকলেও যদি অন্তত দুর্নীতির
রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সেবা
গ্রহণ অনেক বেশি সহজ ও হয়রানিমুক্ত করা সম্ভব। যে শিক্ষক তার পেনশনের টাকার জন্য বছরের
পর বছর সরকারি দপ্তরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত-তাকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারলে, সরকারি হাসপাতালে
বিনা পয়সায় বা অল্প খরচে মানুষের মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে,থানায় বা আদালতে
বিচারপ্রার্থী মানুষের দুর্ভোগ কমানো গেলে গণতন্ত্রে কিছু ছাড় দেয়া যায়। কিন্তু যদি
দুর্নীতি এবং গণতন্ত্রহীনতা একইসঙ্গে চলতে থাকে-তাহলে সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা
থাকে না।
গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন-এই তর্ক অনেকটা ডিম আগে না মুরগির মতো। অনেক
সময় এটা একটা অহেতুক তর্ক। আভিধানিকভাবে দেশে কতটা গণতন্ত্র আছে তার চেয়ে বড় কথা দেশের
সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি কতটা সহনশীল, এখানে ভিন্নমতকে কতটা শ্রদ্ধা
করা হয়-সেটি। কেননা গণতন্ত্র আসলে একটি সদিচ্ছা। অর্থাৎ আমি আপনার কথাকে গুরুত্ব দেব
কি দেব না, সেটি নির্ভর করে আমি কতটা গণতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করি তার উপর। নিয়মিত
বিরতিতে জাতীয় নির্বাচন আর কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনকেই যদি আমরা গণতন্ত্রের
মাপকাঠি বিবেচনা করি এবং পক্ষান্তরে ভিন্নমতকে দমন করতে থাকি, অন্যের গঠনমূলক সমালোচনাকেও
রাজনৈতিক বিরোধিতা মনে করি, সেটি আখেরে গণতন্ত্রের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও ক্ষতিকর।

No comments:
Post a Comment