আমীন আল রশীদ
১৯৭১ সালের ২৫
মার্চ বাংলাদেশে পাক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের পর বিপ্লবী সরকার যে স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র জারি করে, সেখানে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের
জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হলো।’ অর্থাৎ এই যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও
সামাজিক সুবিচারের জন্য দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিসংগ্রাম হলো, সেটিই
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা––এসব অনেক পরে
এসেছে; যখন সংবিধান প্রণয়নের
প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে ওই তিনটি জিনিসকেই (সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার) বুঝায়।
আমাদের
পূর্বপুরুষেরা জানতেন যদি একটি সমাজে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেখানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ,
ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে যায়।
যেহেতু বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষ যাদেরকে ‘দাবায়ে
রাখতে পারবা না’ বলে হুংকার দিয়েছিলেন জাতির জনক––সেই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি যে অবিচার, যে অন্যায্যতা, যে
অসাম্য চাপিয়ে দিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, তার
বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের নামই মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ,
দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম––বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, একটি পতাকা, একটি ভৌগলিক সীমারেখা
অর্জনের ৪৭ বছর পরেও কি আমরা মু্ক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত
করতে পেরেছি, নাকি ক্রমান্বয়ে এই বিষয়গুলো থেকে দূরে,
আরও দূরে সরে যাচ্ছি?
আমাদের সমাজ ও
রাষ্ট্রের কোন স্তরে সাম্য আছে বলে আমরা দাবি করতে পারি? মানবিক মর্যাদা বলে আমরা কিছু কি আর
অবশিষ্ট রেখেছি? সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা কি আদৌ সম্ভব
হয়েছে? এই সবগুলো প্রশ্নের জবাব, না।
যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন, আমাদের
পূর্বপুরুষেরা কেন প্রাণ দিয়েছিলেন? আমরা যে অসাম্যের
বিরুদ্ধে লড়াই করলাম, যে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের
মা বোনেরা সম্ভ্রম হারালেন, যে মানবিক মর্যাদার জন্য ৯ মাস
এক রুদ্ধশ্বাস সময়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছে এই ভুখন্ডের সাত কোটি মানুষ, তার পরিণতি কি শুধুই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র? সেই
রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকরা কিংবা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি দেশ স্বাধীন
হবার প্রায় অর্ধশতক পরে এসেও কেন মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ বা চেতনার বাস্তবায়ন
নিয়ে কেন আমাদের কথা বলতে হয়?
২০১৫ সালের ১৩
ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান
অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো’। এটা ঠিক যে, তিনি বাংলাদেশকে খুশি করার জন্য এই মন্তব্য করেননি, বরং তিনি তাঁর বক্তৃতায় বেশ কিছু রেফারেন্সও দিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত
ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করেও দেখিয়েছেন এর অগ্রগতির চিত্র। কিন্তু
বাস্তবতা হলো, আমরা সব সময়ই উন্নয়নকে দেখি জিডিপি, মাথাপিছু আয়, অবকাঠামো, মানুষের
ক্রয়ক্ষমতা এবং গড় আয়ুর বিবেচনায়। নিঃসন্দেহে এগুলো উন্নয়নের সূচক। কিন্তু উন্নয়ন
মানে যদি হয় মানুষের মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা, একটি
রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্য যদি হয় সেখানে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে সাম্য এবং সামাজিক
সুবিচার নিশ্চিত করা, সেই ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন কি আদৌ
চোখে পড়ে?
আমাদের সম্পদ কি
সামান্য কিছু মানুষের হাতে আমরা তুলে দিইনি? সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা কি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো বলেছে?
একজন মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন, তার
পাশেই লাখ লাখ মানুষের এক কানাকড়ি সম্পদও জমা নেই; কিছু লোক সামান্য
পেট ব্যথা করলেও সিঙ্গাপুর,থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন চিকিৎসা
করাতে, পক্ষান্তরে কোটি কোটি মানুষ জটিল সব রোগে আক্রান্ত
হয়ে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় বারান্দায় ঘোরে।পয়সার অভাবে বিদেশে
তো দূরে থাক, বেসরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য
নেই––এই সংখ্যাটাই তো বেশি। তাহলে সাম্যটা নিশ্চিত
হলো কোথায়? আমাদের রাষ্ট্র ওইসব সম্পদহীন মানুষের একটু ভালো থাকার জন্য ন্যূনতম কী
উদ্যোগ নিয়েছে?
আমাদের চারিপাশে
অজস্র মানুষ যাদের নিজের নামে দুটি, স্ত্রীর নামে তিনটি, সন্তানদের নামে আরও
কয়েকটি বাড়ি-গাড়ি থাকার পরও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, যুক্তরাষ্ট্র
বা যুক্তরাজ্যে বিশাল বাড়ি কিনে রেখেছেন। এই সংখ্যাটা বাড়ছে। ফলে ধনী বা
সম্পদওয়ালা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিকে আমরা যদি উন্নয়নের সূচক হিসেবে ধরে নিই,
তাহলে দেশ সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর খবর কী? এখনও আমাদের
কোটি কোটি মানুষের নিজস্ব একটি ঘর নেই। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে বলেছেন,
গৃহহীনদের ঘরে তৈরি করে দেয়া হবে। সেই ঘর হয়তো ভূমিহীন বা সমাজের
একেবারে প্রান্তিক মানুষেরা পাবেন, কিন্তু যারা
নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি––যারা না খেয়ে থাকলেও কারো কাছে হাত পাতে না, যাদের নিজেদের ঘর না থাকলেও সরকারের কাছে গিয়ে
একটি ঘরের জন্য হাত পাতবে না, সেই বিশাল জনগোষ্ঠীর কী হবে?
এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সবচেয়ে সবচেয়ে বড় সংকট আত্মমর্যাদা, সেটি তারা বেহাত হতে দিতে চায় না। ফলে তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে থাকে।
কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সংকট অনেক সময়ই পাখির চোখ দিয়ে
দেখে। ফলে যে সাম্য ও সামাজিক সুবিচারের কথা আমাদের
পূর্বপুরুষেরা লিখে গেছেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে––তা এখনও ‘দিল্লি বহুদূর’।
আমরা আইনের শাসন
ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারিনি। গণতন্ত্রের নামে নিয়মিত বিরতিতে ভোট হলেও তা
ব্যালটতন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট যে পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, ভিন্নমতের
প্রতি শ্রদ্ধা এবং শাসন প্রক্রিয়ায় সরাসরি জনগণের অংশগ্রহণ––সেসব এখন ‘কাজীর গরু
কেতাবে আছে’।
আমাদের প্রশাসন, আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও
জনবান্ধব তো নয়ই, বরং ক্রমান্বয়ে তারা গণবিরোধী। যে জনগণের
করের পয়সায় তাদের রুটিরুজির ব্যবস্থা হয়, সেই জনগণকেই তারা
প্রতিনিয়ত নাজেহাল করে এবং আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকেই তারা বিবিধ উপায়ে রাষ্ট্রের
সম্পদক নিজেরে মালিকানায় নিয়ে ভোগদখল করে। জনগণ নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে থাকে। আর
এইসব ক্ষমতাবানরা যেহেতু ভোটের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখার একটি বড়
হাতিয়ার, তাই আমাদের সরকাগুলোও গণকর্মচারিদের গণবিরোধী
কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে চুপ থাকে।
আমাদের
রাষ্ট্রের ভেতরে ভেতরে ঘুণ পোকার মতো বাসা বেঁধেছে উগ্রবাদ, মৌলবাদ এবং যার পরিণতি জঙ্গিবাদ। আমরা
আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের মধ্যেই রয়েছি। যার আলামত কিছুদিন পরপরই আমরা পাই। ‘জাফর ইকবালরা মুরতাদ, তাদের হত্যা করা ঈমানি দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে
মৃত্যু হলে বেহেশত নিশ্চিত’––এই ধারণার লোকের সংখ্যা বাড়ছে এবং কী হারে বাড়ছে, তা জানা মুশকিল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর
দ্বারপ্রান্তে এসে যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বাস্তবায়ন হয়েছে কি হয়নি, সেই হিসাব মেলাতে হয় তাহলে বুঝতে হবে কোথাও একটা বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে।
এবং সেই গলদের বাইপ্রোডাক্টের নামই হলো জঙ্গিবাদ।

No comments:
Post a Comment