Sunday, March 11, 2018

কেউ কি নিরাপদ?




আমীন আল রশীদ
প্রখ্যাত লেখক, অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাত করেছে ফয়জুর নামে যে তরুণ, সে দাঁড়িয়েছিল স্যারের ঠিক পেছনেই। স্যার যে চেয়ারে বসেছিলেন, ঠিক তার পেছনের সারিতেই দাঁড়ানো ছিলেন তিনজন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে দুজন মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ফেসবুক ও গণমাধ্যমের কল্যাণে এই ছবি সারা দেশের মানুষই দেখেছে।

গত ৪ মার্চ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠান চলার সময় মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর এই হামলা হয়। তাকে প্রথমে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয় পরে নিয়ে আসা হয় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ।
জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণকারী ফয়জুল হাসান ওরফে ফয়জুরকে সাথেসাথেই ধরে ফেলেন শিক্ষার্থীরা। গণপিটুনিতে সেও গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে পুলিশে দেয়া হয়। পুলিশ ও গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ২৩ বছর বয়সী ফয়জুল হাসানের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। ফয়জুল সিলেট শহরে এবং অন্যত্র একাধিক মাদ্রাসায় পড়েছে। তবে এইচএসসি সমমানের আলিম পড়ার সময় সে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। পরে  একটি কম্পিউটারের দোকানে পিনের কাজ নিলেও ফয়জুল সেটি ছেড়ে দেয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের অক্টোবরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তার স্ত্রী ইয়াসমিন হককে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে জাফর ইকবালের নিরাপত্তায় পুলিশ দেয়া হয়। কিন্তু সেই পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতেই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা হলো। তাও জনহীন কোনো রাস্তা বা নিরব এলাকায় নয়। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল এ যাত্রা বেঁচে গেছেন। তিনি আরও বহু বছর আমাদের মাঝে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে বেঁচে থাকবেন, এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু এই হামলা আমাদের মনে প্রধানত যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তা হলো, আমরা কেউই কি নিরাপদ? নিরাপত্তা মানেই যে আমাদের ওপর জঙ্গি হামলা হবে না, সেটিই নয়। বরং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র আমাদের কতটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে?
সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করি কেন ২৩ বছরের একজন তরুণ তার বাবার বয়সীই শুধু নয়, দেশের একজন শীর্ষ লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের ওপর হামলা করলো এবং এই দুঃসাহস সে কোথায় পেলো? শুধু তাই নয়, সে এমন একটি জায়গায় এবং এমন একটি সময়ে এই হামলা করেছে, যেখানে তার ধরা পড়ে যাওয়ায় সম্ভাবনা ছিল একশো ভাগ এবং ধরা পড়লে গণপিটুনিতে তার যে মৃত্যুও হতে পারে, নিশ্চয়ই সেই বিবেচনাও তার ছিল। আসলেই কি ছিল?
ফয়জুরের মতো অসংখ্য তরুণের বিবেচনাবোধ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাদের মগজ ধোলাই করে বেহেশতের খোয়াব দেখানো হয়েছে। তাদের মোটিভেটররা এটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, জাফর ইকবালরা আল্লাহ ও তার রাসুলের দুশমন। অতএব তাদের হত্যা করতে পারলে জান্নাত নিশ্চিত। ফলে একজন অল্পশিক্ষিত তরুণ যখন তার সামনে কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে না পায়, যখন তার সামনে কোনো স্বপ্ন নেই, তখন খুব সহজেই তাকে প্রভাবিত করে, একদিকে বেহেশতের লোভ অন্যদিকে পার্থিব আরও অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বলে তাকে হয়তো বিভ্রান্ত করা সম্ভব।
বলা হয়, পৃথিবীতে মগজ ধোলাইয়ের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র নেই। একজন লোককে ১০ লাখ টাকা দিয়ে একটি অন্যায় করানো যত সহজ, তার চেয়ে অনেক সহজ তার মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে। এবং সে হয়তো টাকা-পয়সা ছাড়াই কোথাও গিয়ে একটা বোমা মেরে দিয়ে আসবে। কারো শরীরে চাপাতি দিয়ে পাঁচটা কোপ দিয়ে আসবে। একজন তরুণ, যুবক বা মাঝবয়সী লোককে এভাবে হিপটোনাইজ করে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো, এরকম কতজন ফয়জুরের মগজ ধোলাই করা হয়েছে? আরও কারা কারা তাদের চাপাতি কিংবা ছুরির টার্গেটে রয়েছেন?
হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পরে সারা দেশে যে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হয়, তখন অনেক জায়গায়ই দেখা গেছে, জঙ্গিরা একা নয় বরং তাদের সাথে এই মরণখেলায় তারা তাদের স্ত্রী এমনকি নিষ্পাপ শিশুসন্তানকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েই আছে। ফলে একজন ব্যক্তি যখন জঙ্গিবাদের দিকে যায় এবং যদি সে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তাকে চিহ্নিত করা সহজ। কিন্তু যদি সে পুরো পরিবারকেই এই প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসে এবং জনমানুষের মধ্যেই সে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করে, তখন তাকে চিহ্নিত করা কঠিন, বেশ কঠিন। ফলে কত শত বা কত হাজার পরিবার এরকম আত্মঘাতী হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে, তা আমাদের জানা নেই। জানা নেই বলেই আমাদের মনে সেই প্রশ্নটিই উঁকি দেয়, আমার কেউই নিরাপদ কি না?
একজন সাধারণ অপরাধী যখন কারো ওপর হামলা চালায়, সেখানে প্রথমে সে নিজেকে বাঁচাতে চায়। সে আত্মঘাতী হতে চায় না। সে ধরা পড়তে চায় না। আবার ধরা পড়লেও সে অপরাধের কথা অস্বীকার করে। কিন্তু এই সাধারণ অপরাধীদের সঙ্গে বিশেষায়িত অপরাধী অর্থাৎ যারা একটি বিশেষ আদর্শে উজ্জীবীত বা কোনো মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চরমপন্থা বেছে নেয়, তাদের মধ্যে নিজেকে বাঁচানোর প্রবণতা কমে আসে। তারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আত্মঘাতী হতেও দ্বিধা করে না। কারণ তখন তাদের সামনে টার্গেট ফিক্সড করা থাকে। ফলে এটিই আমাদের আতঙ্কিত হবার কারণ।
একজন ফয়জুর বিপথগামী তরুণ। সে যে জাফর ইকবালের কোনো একটি লেখা পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তার ওপর ছুরি নিয়ে হামলা চালিয়েছে––এমন সরল সমীকরণের  সুযোগ নেই। বরং ফয়জুর এখানে কেবল একজন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী মাত্র। এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে অনেকগুলো পর্যায় থেকে। অনেকগুলো প্রক্রিয়ায়। কারণ জাফর ইকবাল দেশের কোনো সাধারণ নাগরিক নন যে, কেউ একজন এসেই তার গায়ে একটা ছুরির পোচ দিয়ে চলে যাবে। বরং এটি ধরে নেয়াই সঙ্গত যে, তার উপর হামলার পরিকল্পনাটি অনেক দিন ধরেই হচ্ছিলো এবং ঠিক কবে কখন কীভাবে তার ওপর হামলা হবে, নিশ্চয়ই তারও একটা ছক তারা এঁকে নিয়েছিল। তবে সেই ছকটি পুরোমাত্রায় কার্যকর হয়নি। হলে জাফর ইকবালের এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকার কথা নয়।
প্রশ্ন এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকে। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষাথী-অভিভাবকসহ সব বয়সী মানুষের অবাধ যাতায়াত থাকে। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কে কাকে চেনে? কে কাকে কী জিজ্ঞেস করবে? ফলে ফয়জুর যখন পকেটে ধারালো ছুরি  নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকলো, কে তাকে আটকাবে? সে যদি পকেটে পিস্তল নিয়ে ঢুকতো এবং জাফর ইকবালের মাথায় গুলিও করতো, তাও ঠেকানো সম্ভব ছিল না। কারণ যে তাকে মারতে এসেছে, সে ধরা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই এসেছে। না হলে সে জাফর ইকবালকে নিরিবিলি কোথাও মারার চেষ্টা করতো।
তার মানে হলো, ওই তরুণের মনের ভেতরে জাফর ইকবাল সম্পর্কে তীব্র ঘৃণার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে এবং তাকে বোঝানো হয়েছে এটি একটি জিহাদ এবং এই জিহাদে শহীদ হলে তার পরকালের জীবন নিশ্চিত। এই মগজ ধোলাইগুলো কত শক্তিশালী এবং কীভাবে হয়, তার অনেক বিবরণ আমরা হলি আর্টিজানের পরে বিভিন্ন অভিযানে আটক জঙ্গিদের জবানবন্দিতে পেয়েছি। ফলে সেই প্রশ্নটিই বারবার আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে যে, কতজন তরুণের মগজ এরকম ধোলাই করা সম্ভব হয়েছে এবং আরও কতজনকে তারা টার্গেট করে রেখেছে?
এখানে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি আসছে তা হলো, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে কি না? সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও এ কথা বলা হয়েছে যে, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের কাজ নয়। এ কথার হয়তো যুক্তি আছে। কারণ ১৬-১৭ কোটি মানুষের দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর তিন চার কিংবা দশ লাখ সদস্যের পক্ষেও সবার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্র যেটি পারে তা হলো, অপরাধপ্রবণতা যাতে না বাড়ে অর্থাৎ মানুষ যাতে অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে, সমাজের কোনো স্তরে যাতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি না হয়, যাতে কোনো একটি গোষ্ঠী বা অংশ নিজেদেরকে প্রান্তিক না ভাবে, যাতে তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন এবং পশ্চাৎপদ না ভাবে, যাতে সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যাতে সুশাসন নিশ্চিত হয়, যাতে মানুষের কথা বলার অধিকার থাকে, সেই সুযোগগুলো নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র যদি এসব করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। একজন দুজন ফয়জুর ধরা পড়বে, তাদের বিচার হবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আরও কত তরুণ এরকম সশস্ত্র হতে থাকবে, তা আমরা জানব না।

No comments:

Post a Comment