Wednesday, September 27, 2017

বিচারপতির বিচার, আইনের শাসন ও বিবিধ তর্ক



আমীন আল রশীদ
রুল অব ল বা আইনের শাসনের সহজ অর্থই হলো আইনের দ্বারা শাসন। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হবে আইনের বিধিবিধান দ্বারা। কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ, দল বা প্রশাসনের বিশেষ কোনো অংশের ইচ্ছা কিংবা বন্দুকের নল অথবা বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের পরামর্শে নয়।
আইনের শাসনের আরেকটি অর্থ আইন সবার জন্য সমান। একই অপরাধে একজন সাধারণ নাগরিকের যে শাস্তি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শাস্তিও তা-ই। এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে তিনি খালাস পাবেন আর সাধারণ নাগরিক জেল খাটবে, এটি আইনের শাসন অনুমোদন করে না। একই কারণে যে বিচারক বা বিচারপতিরা অপরাধের বিচার করেন, তাঁরাও আইনের ঊর্ধ্বে নন। অর্থাৎ অন্যায় করলে তাঁদেরও বিচারের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা প্রতিটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন প্রক্রিয়ায় বিচারকদের বিচার হবে? সাধারণ বিচারব্যবস্থায় যদি বিচারকদের বিচার করা হয়, সেটি বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণœ করে কি না?


বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয়, সেখানেই বিচারকদের অসদাচরণের বিচারের বিধান ছিল। সেখানে উল্লেখ ছিল, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে অভিযুক্ত বিচারককে অপসারণ করা যাবে। কিন্তু পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত করা হয়। এর প্রায় চার দশক পরে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফের ন্যস্ত হয় সংসদের ওপর; ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। তারই আলোকে প্রণয়ন করা হচ্ছে
বাংলাদেশ? সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন। গত ২৫ এপ্রিল যার খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
ওই দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, সংবিধানের দায়বদ্ধতা থেকে এ আইন করা হচ্ছে। মূলত বিচারপতিদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে বিষয়টি আইনে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন,
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তার তদন্ত হবে এ আইনের মাধ্যমে। তদন্তে কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য প্রমাণিত হলে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে। এরপর সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, সেটি যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। তবে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হলে খসড়া আইনে দুই বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে।
কীভাবে অপসারণ হবে?
বিলের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্য-সম্পর্কিত অভিযোগ জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে লিখিতভাবে দাখিল করতে হবে। দাখিলকৃত অভিযোগে সংশ্লিষ্ট বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করতে হবে। অভিযোগের নিচে অভিযোগকারীকে হলফনামা দিতে হবে যে, জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে অভিযোগ সত্য। অভিযোগকারীকে অভিযোগের উৎস সম্পর্কেও তথ্য দিতে হবে। কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর স্পিকার ওই অভিযোগের সত্যতা তদন্তে ১০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে একটি কমিটি করে সেখানে অভিযোগ পাঠাবেন। এই কমিটি গোপনীয়তা রক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত করবে। প্রাথমিকভাবে সত্যতা না পেলে স্পিকার তা ক্লোজ করে দেবেন। আর সত্যতা পেলে স্পিকারকে লিখিতভাবে প্রতিবেদন দিতে হবে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর জাতীয় সংসদের গোপন বৈঠক হবে। বৈঠকে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করার প্রয়োজন মনে করলে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হবে। এই কমিটিতে কোনো সংসদ সদস্য থাকবেন না। সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতি এই কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিশিষ্ট নাগরিক বা আইনজ্ঞ কমিটিতে থাকবেন। তবে কমিটিতে থাকার জন্য সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের বয়স ৬৭ গ্রহণযোগ্য হলেও অন্যদের ৬৭ বছরের বেশি হতে হবে। তিন সদস্যের এই কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্তই কমিটির সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে।
কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ গোপনীয়ভাবে তদন্ত করা হবে এবং এরপর চার্জ ফ্রেম করা হবে। ১০ দিনের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অভিযুক্তকে সুযোগ দিতে হবে। তাঁর বক্তব্য শোনার পরে কমিটি যদি মনে করে অভিযোগের ভিত্তি নেই, তবে স্পিকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। আর অভিযোগের ভিত্তি থাকলে সেটিই সংসদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে এবং প্রতিলিপি বিচারকের কাছে পাঠানো হবে। এভাবে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর বিষয়টি সংসদে উঠবে। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য সম্মতি দিলে সংসদের ওই সিদ্ধান্ত যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি তাতে সই করার পরেই অভিযুক্ত বিচারককে অপসারণ করা হবে।
দেখা যাচ্ছে, কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করতে হলে তার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও দীর্ঘ। আগের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়েও। ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হলেও এখানে সংসদের একচ্ছত্র ক্ষমতা নেই। বরং সংসদ সদস্যরা প্রাথমিক তদন্ত করবেন। সেখানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেটি যাবে তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে। সেই কমিটি যদি অভিযোগের সত্যতা পায়, তখন সেটি সংসদে উঠবে ভোটের জন্য। আবার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলেই কেবল সেটি অনুমোদিত হবে।
সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সম্মতি দিলেই একটি বিল পাস হয়। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের জন্য কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটই যথেষ্ট নয়; বরং সেখানে সংসদের মোট সদস্যের ?দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন লাগে। একইভাবে কোনো বিচারককে অপসারণ করতে চাইলেও সংবিধান সংশোধনের মতো দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি লাগবে। যদি কোনো সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যায় খুব বেশি পার্থক্য না থাকে, তখন একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও কেবল দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের অভাবে তাকে অপসারণ করা যাবে না। কারণ কোনো বিচারককে অপসারণ করতে হলে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্য থাকতে হবে। এসব বিবেচনায় নিয়েই সরকার বলছে, বিচারপতিদের কোনো রকম যেন অসম্মান না হয়, সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে এই আইনে।
কেন সংবিধান সংশোধন?
পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ২০১২ সালে সড়ক ভবনকে কেন্দ্র করে আদালতের একটি রায় দেন, যা নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় এবং এ বিষয়ে তৎকালীন স্পিকার এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একটি রুলিং দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী স্পিকারের ওই বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে মন্তব্য করেন। এরপরই ওই বিচারকের অপসারণের দাবি ওঠে সংসদে। এ সময় সংসদ সদস্যরা বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আলোকে সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
এর দুই বছর পরে পাস হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী যেখানে বিচারকদের অপসারণ-সম্পর্কিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। ওই সময়ে বিলের উদ্দেশ্য ও কারণসংবলিত বিবৃতিতে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। আইন অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না।’ আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করার পক্ষে নই। এক বালতি দুধে খারাপ কিছু পড়লে পুরো দুধই নষ্ট হয়ে যায়। বিচার বিভাগ নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন, আমরা তাঁদের রক্ষা করতে চাই।’
কারা বিচার করবেন?
আমাদের দেশে কারা আইনপ্রণেতা হন এবং তাঁদের কী যোগ্যতা, তা নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জাতীয় সংসদে আলোচনা-পর্যালোচনা না হওয়ায় প্রতিটি আইনই ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ রয়ে যাচ্ছে। সংসদ সদস্যদের আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এর আগে সংসদে আইনের ওপর ব্যাপক আলোচনা-বিতর্ক হতো। কিন্তু এখন তা হয় না। ফলে আইনসভায় আইনের চর্চা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। জনগণ ভোগান্তিতে পড়ে। বিচার বিভাগেও চাপ পড়ে।’
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন টিআইবি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছিল, আইন প্রণয়নে সংসদ সদস্যরা কেবল ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলেন। আইন প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় তাঁদের কার্যকর অংশগ্রহণ নেই।
কারা আইনপ্রণেতা হবেন, কী তাঁদের যোগ্যতা থাকতে হবে, তার কোনো নির্দেশনা সংবিধানেও নেই। বরং ২৫ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন। অথচ আইন প্রণয়নপ্রক্রিয়াটি খুবই জটিল এবং এখানে যথেষ্ট পড়াশোনার বিষয় থাকে। কিন্তু একজন আধাশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত লোকও সংসদ সদস্য হয়ে যাচ্ছেন এবং তখন বাস্তবিক কারণেই আমলারা যে বিলের খসড়া তৈরি করে দেন, তাতে সংসদ সদস্যদের ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলা ছাড়া কিছু করার থাকে না। কারণ, একটি বিলের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরার জন্য ন্যূনতম যে পড়াশোনা ও যোগ্যতা থাকা দরকার, সেটি ছাড়াও সংসদ সদস্য হওয়া যাচ্ছে।
আইনে কী আছে বা নেই, তার চেয়ে বড় বিষয় আইনের প্রয়োগ কখন কোথায় কীভাবে হচ্ছে। আইন প্রয়োগে সরকারের ইনটেনশন বা ইচ্ছাটা কী, তার ওপরেই নির্ভর করে আইনের প্রয়োগ। অনেক ভালো আইনও অকার্যকর হয়ে থাকতে পারে, যদি সরকার সেটি ব্যবহার করতে না চায়। আবার অনেক দুর্বল আইনও বড় কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে, যদি প্রয়োগকারীরা সেটিকে প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণে ব্যবহার করেন।
এটি ঠিক, আইন বিভাগ (সংসদ) ও বিচার বিভাগ কেউ কারও প্রতিপক্ষ নয়; বরং পরিপূরক। সংসদে প্রণীত আইনের দ্বারা যেমন আদালত পরিচালিত হন, তেমনি কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সেটি বাতিলের ক্ষমতাও আছে আদালতের। আবার সংবিধানের ব্যাখ্যা করার চূড়ান্ত এখতিয়ারও উচ্চ আদালতের। সুতরাং একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স বা ভারসাম্য বরাবরই ছিল এবং বিচারকদের অপসারণ-সম্পর্কিত আইন সেই ভারসাম্য নষ্ট করবে না বলেই দেশের মানুষ বিশ্বাস করে।

No comments:

Post a Comment