আমীন আল রশীদ
‘বিচারপতি তোমার
বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা’র প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,বিচারকদের
বিচারের ভার তাদের হাতেই থাকবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহাত্তরে যে সংবিধান প্রণয়ন
করা হয়, সেখানেই এই বিধান ছিল। কিন্তু মাঝখানে বহু বছর সেই ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে
চলে যায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে। ষোড়শ সংশোধনী এনে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন
করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের সেই বিধান ফিরিয়ে আনা হলেও সর্বোচ্চ আদালত সেই সংশোধনী
বাতিল করে দিয়েছেন।
যে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ৯৬ অনুচ্ছেদ
সংশোধন করে বিচারকদের বিচারের ভার সংসদের কাছ থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ন্যস্ত
করেছিলেন, সেই পঞ্চম সংশোধনী উচ্চ আদালত বাতিল করলেও ৯৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করেননি। যেমন
বাতিল করা হয়নি ওই সংশোধনীর সময়ে অন্তর্ভুক্ত সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’।
বাহাত্তরের মূল সংবিধানে বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদে বিধান
ছিল, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থের প্রমাণ পেলে এবং সংসদের মোট সদস্যের
অন্যূন দুই তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলে রাষ্ট্রপতির আদেশে ওই বিচারককে অপাসরণ করা যাবে।
কিন্তু ১৯৭৬ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ
সায়েম সংসদ ভেঙে দিলে প্রশ্ন ওঠে, যদি সংসদ না থাকা অবস্থায়ে কোনো বিচারককে অপসারণের
প্রয়োজন দেখা দেয় বা কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগের তদন্তের প্রয়োজন হয়;আবার
সংসদ থাকা অবস্থায় যদি দুই তৃতীয়ংশ সদস্যের সম্মতি না পাওয়া যায়, তাহলে বিচারকদের অপসারণের
বিষয়টি কীভাবে মীমাংসা হবে? এ পরিস্থিতিতে ১৯৭৭ সালের ২৭ নভেম্বর সামরিক ফরমান বলে
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান করেন জিয়াউর রহমান; পরে যা পঞ্চম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত
হয়।যদিও সংসদে হোক আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলেই হোক, যেকোনো বিচারকের অপসারণ বেশ
দুরুহ। বরং ষোড়শ সংশোধনীর আলোকে বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত বিলের যে খসড়া তৈরি করা
হয়েছে, সেখানে একজন বিচারকের অপসারণের প্রক্রিয়া আরও কঠিন।
মৌলিক কাঠামোর
তর্ক:
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক উঠছে অন্য কারণে। সর্বোচ্চ আদালত ষোড়শ সংশোধনীকে
‘অসাংবিধানিক’ উল্লেখ করে এটি
বাতিল করেছেন। আদালতের যুক্তি এই সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় আঘাত হেনেছে। যদিও
বাহাত্তরের মূল সংবিধানেই এই বিধান ছিল। ৯ জুলাই রাতে সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে যে আলোচনা
হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র এমপিরাও প্রশ্ন তুলেছেন, ৯৬ অনুচ্ছেদ
সংশোধন কীভাবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় আঘাত করেছে তা পরিস্কার নয়।
তবে এটা ঠিক, আগে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামো কী এবং
কোন অনুচ্ছেদগুলো সংশোধন অযোগ্য তা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা থাকলেও পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় একটি
অনুচ্ছেদ (৭ এর খ) যুক্ত করে সেটি পরিস্কার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,সংবিধানের
১৪২ অনুচ্ছেদে যা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রজাতন্ত্র, প্রজাতন্ত্রের
রাষ্ট্রীয় সীমানা, রাষ্ট্রধর্ম, রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় সংগীত, পতাকা ও প্রতীক, জাতির পিতার
প্রতিকৃতিসহ প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ; সংবিধানের ৪ মূলনীতি,সুযোগের সমতা,নির্বাহী
বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণসহ দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ; চিন্তা ও বিবেকের
স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতাসহ তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের সব অনুচ্ছেদ এবং নবম-ক
ভাগ অর্থাৎ জরুরি অবস্থা ঘোষণা;একাদশ ভাগের ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী সংশোধন
করা যাবে না।
ফলে দেখা যাচ্ছে, বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের
বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামোর অংশ নয়। অতএব এটি সংশোধনযোগ্য। যদিও নির্বাহী বিভাগ
হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্পর্কিত অনুচ্ছেদও যেহেতু মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত,
সেই যুক্তিতে হয়তো বলা হচ্ছে যে,বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে হাতে দেয়া অসাংবিধানিক।
এ বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে নিশ্চয়ই বিষয়টির ব্যাখ্যা মিলবে।
যদিও মৌলিক কাঠামো বলে সংবিধানে আদৌ কিছু থাকা উচিত কি না তা নিয়েও
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেননা সংবিধানের কেনো এক বা একাধিক অনুচ্ছেদকে এখন মৌলিক
কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলোকে সংশোধনের অযোগ্য বলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও
৫০ বছর পরের প্রজন্ম সেই সময়ের প্রয়োজনে সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারবে না,
এমন তো নাও হতে পারে।
বাহাত্তরের দোহাই:
গত ৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সম্পর্কিত হাইকোর্টের রায় বহাল
রেখে আপিল বিভাগ যেদিন রায় দেন, সেদিন হতাশা প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট
মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের স্বপ্ন ছিল ৭২ এর আদিসংবিধানে ফেরা। কিন্তু এই
রায়ের মধ্যে দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। এজন্য আমরা দুঃখ ও হতাশা প্রকাশ করছি।
৯ জুলাই রাতে সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে যে আলোচনা হয়, সেখানেও সংসদ সদস্যরা
বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নতুন কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বরং বাহাত্তরের
মূল সংবিধানে যা ছিল সেটিই কেবল পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে।
বাস্তবতা হলো, কথায় কথায় এই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি
একধরনের পলিটিক্যাল স্টান্টবাজি। কেননা, বাহাত্তরের সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্ম
ছিল না। বিসমিল্লাহ অন্তর্ভু্ক্ত করেছেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে।
আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন আরেক সামরিক শাসক এরশাদ, অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে।
এ দুটি ক্ষেত্রেই বাহাত্তরের সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার
চেতনায় আঘাত করা হয়েছে। কিন্তু যারা পঞ্চদশ এবং ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ বাহাত্তরের
মূল সংবিধানে ফিরে গেছে বলে দাবি করেন, তারাও এই ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে নারাজ।
অথচ তারা বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আলোকে ৯৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনতে চান। তার চেয়ে বড়
কথা, বাহাত্তরের সংবিধান যেমন ছিল, ২০১৭ সালে সংবিধানের চেহারা তেমনই থাকতে হবে,এর
কী যুক্তি আছে?
সাংবিধানিক শূন্যতা?
স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ফলে বিচারকদের
অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ মনে
করেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পরে যতক্ষণ না
সংবিধানে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, অর্থাৎ যতক্ষণ না ৯৬ অনুচ্ছেদকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে
নেয়ার বিধানটি যুক্ত করে নতুন করে সংবিধান ছাপানো হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি একটা সাংবিধানিক শূন্যতা বিরাজ করবে। প্রশ্নটা উঠছে
এ কারণে যে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রপতিশাসিত
সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীর ফলে চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হয়ে
যায়। এর বহু বছর পরে যখন সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন, তখন কি দেশ
পঞ্চম সংশোধনীর আগের অবস্থায় অর্থাৎ একদলীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে গিয়েছিল? তা হয়নি। সুতরাং
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হলেও যতক্ষণ না সংবিধান পুনর্মূদ্রণ হচ্ছে ততক্ষণ ধরে নিতে
হবে যে, এখনও বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রয়েছে।
দেশে সাড়ে ছয়শোরও বেশি আইন আছে। সব আইনের প্রয়োগ হয় না। আবার অনেক আইনের
অপপ্রয়োগও হয়, যেমন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা। অর্থাৎ আইনের প্রয়োগ নির্ভর করে আইনপ্রয়োগকারীর
সদিচ্ছার উপর। ফলে সরকার যতই বলুক যে, তারা বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য
৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারকদের অপসারণের ভার সংসদের ওপর ন্যস্ত করেছে, এর পেছনে
মূল উদ্দেশ্য যে বিচার বিভাগকে চাপে রাখা, সে বিষয়ে সন্দেহ কম।তাছাড়া ৭০ অনুচ্ছেদের
মতো ধারা (দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য পদ বাতিল) বহাল রেখে বিচারকদের অপসারণের
ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করাও আইনের শাসনের সাথে খাপ খায় না।
যদিও আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন বলেই বিষয়টা এখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বরং
এখনও রিভিউয়ের সুযোগ আছে। সুতরাং রিভিউতেও যদি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল
থাকে, তখন সংসদ কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।সংসদ যদি শেষ পর্যন্ত আদালতের
এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তখন কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা অবশ্য এখনই বলা
মুশকিল।
আমীন আল রশীদ:
সাংবাদিক ও লেখক।
No comments:
Post a Comment