Monday, April 30, 2018

বজ্রপাত কি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ?


আমীন আল রশীদ
২০১৪ সালে বজ্রপাত নিয়ে বিবিসির জন্য একটি রিপোর্ট করতে গিয়ে জানতে পারি, সরকার প্রতি বছর প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতির যে তালিকা করে, সেখানে বজ্রপাত নেই। বিষয়টি নিয়ে তখন দৃষ্টি আকর্ষণ করি ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালকের। তিনি জানান, প্রাণহানি ও অন্যান্য ক্ষয়-ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে তারা বজ্রপাতকেও দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এর বছর দুই পরে ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

এই নিবন্ধটি যেদিন (৩০ এপ্রিল)লিখছি, সেদিন বিকেল পর্য‌ন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী,দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রাঘাতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ঠিক আগের দিন নিহত হয়েছেন আরও ১৮ জন, যাদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার তেকানী চরে সামছুল হক নামে এক কৃষক এবং তার ছেলে আরফানও রয়েছেন। প্রসঙ্গত, এই দুদিনে নিহতের একটা বড় অংশই কৃষক, যারা বজ্রপাতের সময় মাঠে কাজ করছিলেন। প্রতি বছর বজ্রপাতে যাদের মৃত্যু হয়, পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, এর একটা বড় অংশই কৃষক, যাদেরকে বলা হয় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির প্রাণ। অথচ সেই মানুষগুলোর প্রাণই চলে যাচ্ছে বেঘোরে। তাহলে কি এই মৃত্যু ঠেকানোর কোনো তরিকা নেই?
বাংলাদেশে যখন এই ঘটনাগুলো ঘটছে, তার কয়েকদিন আগেই দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে ১৩ ঘণ্টায় ৩৬ হাজার ৭৪৯ বার বজ্রপাতের রেকর্ড করে সে দেশের আবহাওয়া দপ্তর।বজ্রপাতের এমন অস্বাভাবিক আচরণকে আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা বলে উল্লেখ করেছে ভারতের দুর্যোগব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে এখনও কোনো উপসংহারে পৌঁছানো না গেলেও বিজ্ঞানীদের অনেকে বিশ্বাস করেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়তে থাকায় বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে। যদি তাই হয়, তখন আমাদের এই প্রশ্নও উত্থাপন করতে হবে যে, বজ্রপাতের এমন প্রাণহানি কি তাহলে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ? কেননা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনকে এখন মানুষের তৈরি দুর্যোগ বলে অভিহিত করা হয়। অতি শিল্পায়ন, নগরায়ণ আর ভোগবাদিতা বেড়ে যাওয়া তথা বাতাসে অধিকমাত্রায় কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের ফলেই যেহেতু বিশ্বের সামগ্রিক তাপমাত্রা বাড়ছে এবং তার অবশ্যম্ভাবি পরিণতি হিসেবে অধিকহারে মেরুর বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, সে কারণে জলবায়ু পরিবর্তন যে মানুষের সৃষ্ট, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে। সুতরাং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির সঙ্গে যদি বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক প্রমাণিত হয়, তাহলে বলতে হবে, প্রতি বছর এই দুর্যোগে মানুষের প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার দায় মানুষকেই নিতে হবে। বিশেষ করে যেসব শিল্পোন্নত দেশ জলবায়ু পরিণতির জন্য প্রধানত দায়ী।
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে বজ্রপাত এবং এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বজ্রপাতে মৃত্যু আসলেই বেড়েছে নাকি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়গুলো বেশি করে আসছে বলে মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশি মনে হচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে আমাদের অন্তত বিগত ১০/১৫ বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান ঘেঁটে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে। এখানে সমস্যা হচ্ছে, ২০১৬ সালের আগ পর্য‌ন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর তালিকা সরকারের তরফে করা হত না। ফলে বিগত ১০/১৫ বছরে দেশে আসলেই কত লোক বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন, সেই পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। আবার স্থানীয় ও আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকা বিশ্লেষণ করে এর একটা মোটামুটি  চিত্র পাওয়া গেলেও সেটিও যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা হবে না, তা নিশ্চিত।
বেসরকারি সংগঠন দুর্যোগ ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, বাজ পড়ে অর্থাৎ বজ্রপাতে ২০১১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পরের বছর ২০১ জন এবং ২০১৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ২৮৫। তার মানে প্রতি বছরই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।
বজ্রপাত যে আগের চেয়ে বেড়েছে, তা আবহাওয়াবিদরাও স্বীকার করেছেন। এর কারণে নিয়ে এখনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও বিজ্ঞানীদের একটি অংশ বলছেন, যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকেই বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে। কোনো কোনো গবেষক বলেন, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের আশঙ্কা অন্তত ১০ শতাংশ বেড়ে যায়।
২০০৯ সাল থেকে বজ্রপাতের ওপর গবেষণা চালিয়েছিল বিলুপ্ত প্রতিষ্ঠান সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রে (এসএমআরসি)।এই কেন্দ্রের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। সার্কভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় বজ্রপাতে এখানে মৃত্যুর হারও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে।
বজ্রপাতে কোনো মৃত্যুই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোন কিংবা কৃষক। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বজ্রপাতে নিহতদের অধিকাংশই কৃষক বা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। যারা মূলত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এরকম একজন ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পুরো পরিবারটি অকুলপাথারে পড়ে যায়। ২০১৪ সালে ফরিদপুরে বজ্রপাতে নিহত এবং আহত কয়েকটি পরিবারের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সেই দুর্দশা জানার সুযোগ হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যু কি ঠেকানোর কোনো উপায় নেই?
নিশ্চয়ই আছে। বজ্রপাতের সময় বাইরে না থাকলেই মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। কিন্তু বজ্রপাত তো বলে কয়ে আসে না। ঘূর্ণিঝড়ের মতো বজ্রপাত কখনো আগাম সংকেত দেয় না। তবে এই মৌসুমে, বিশেষ করে এপ্রিল-মে মাসে যখনই আকাশ কালো হয়ে হয়ে আসে এবং আকাশের চেহারা ও বাতাসের গতিবেগ দ্রুত বাড়তে থাকে, তখন সাথে সাথে খোলা জায়গা মাঠের ভেতরে থেকে দৌড়ে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে চলে গেলে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদিও ঘরের ভেতরেও বজ্রপাত হতে পারে। কিন্তু সেই সংখ্যা অতি সামান্য। সে কারণে বলা হয়, টিনের ঘর হোক আর দালানের, আর্থিং ব্যবস্থা থাকলে সেই ঘরে বজ্রপাত আঘাত হানবে না। যখন বজ্রের ঝনঝনানি শুরু হয়, তখন বাইরে থাকলেও উঁচু গাছের নিচে না দাঁড়ানো এবং পানিতে থাকলে  দ্রুত ডাঙায় উঠে আসার পরামর্শ দেয়া হয়। আবার ঘরের ভেতরে থাকলেও বজ্রপাতের সময় ধাতুর তৈরি কোনো কিছু স্পর্শ না করারও পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।
বলা হয়,গ্রাম ও শহরে উঁচু গাছের পরিমাণ কমে গেছে বলে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। কেননা উঁচু গাছ বজ্রকে মাটিতে নামতে দেয় না। সে কারণে এখন অনেকেই সারা দেশে বেশি করে তাল গাছ রোপণের কথা বলছেন। সরকারও তালগাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করছে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। কেননা একটি তালগাছ বড় হতে যে ১৫/২০ বছর সময় লাগবে, সেই সময়কালে মৃত্যু আমরা কী করে ঠেকাব? তার মানে এখনই যদি সারা দেশে লাখ লাখ তালগাছ লাগানো হয়, তার সুফল হয়তো ২০ বছর পরে পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন আমরা কী করব?
তাৎক্ষণিক সমাধান গ্রামাঞ্চলে উঁচু টাওয়ার বানানো যাতে বজ্র মাটি পর্য‌ন্ত আসতে না পারে। সব বাড়িঘরে আর্থিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করে দেয়া এবং গরিব মানুষকে প্রয়োজনে সরকারের স্যানিটারি ল্যাট্রিন করে দেয়ার মতো আর্থিং ব্যবস্থা করে দেয়া যায়। এপ্রিল-মে মাসে মাঠ ঘাটে কাজ করা কৃষক ও দিনমজুরদের একটু বেশি সতর্ক থাকা। আকাশের অবস্থা খারাপ দেখলেই দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসা। এরকম ছোটখাট উদ্যোগ বা সচেতনতা বজ্রাঘাতে মৃত্যু কমিয়ে আনতে পারে।

No comments:

Post a Comment