আমীন আল রশীদ
দেশের ব্যাংক ও আর্থিক
খাত কীরকম বিশৃঙ্খলা আর অনিয়মের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা জাতীয় সংসদে খোদ
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট।২০১৬ সালের ৭ জুন তিনি সংসদে বলেছিলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে পুকুরচুরি নয়, বরং সাগরচুরি হয়েছে।’ কিন্তু সেই সাগরচুরির বিষয়ে কোনো ‘নেতিবাচক’ সংবাদ প্রচার করা যাবে না––এমন এক অদ্ভুত আবদার জানানো হয়েছে অ্যাসোসিয়েশন
অব ব্যাংকস বা এবিবির তরফে। ঋণ কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংক খাতের ‘নেতিবাচক’ সংবাদ বন্ধ করতে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে
গত ৩০ মার্চ তারা একটি চিঠি দিয়ছে। যদিও এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সংসদে আগামী বাজেট ঘোষণার সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন
বলছে, বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার স্বাক্ষরিত ওই
চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনফরমেশন অ্যাক্টের আওতায় একটি প্রতিষ্ঠান
গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক প্রচারণা’ বন্ধ করা হবে। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে অর্থ
মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে। এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়েছে,
ব্যাংকিং খাত নিয়ে গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে জনজনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গ্রাহকরা ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন।
প্রশ্ন
হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, জনতা
ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর তো সাংবাদিকরাই
অনুসন্ধান করে বের করেছেন এবং তারপরে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে।
যদি গণমাধ্যম ওই দুর্নীতি বের না করতো, তাহলে কি কোনোদিন অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ওই সাগরচুরি
প্রকাশ পেতো? তার মানে কি এই যে,যারা সাগরচুরি করবেন, তারা দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে
নিজেদের বাপ দাদার সম্পত্তি মনে করেন এবং তারা নিজেদের মতো এসব লুটপাট করবেন কিন্তু
কেউ কিছু বলতে পারবে না? এমন অদ্ভুত ও অশ্লীল আবদার এর আগে কেউ করেছে? পৃথিবীর কোনো
সভ্য দেশে এরকম আবদার করার সুযোগ আছে যে, আমি চুরি করব অথচ কেউ আমাকে চোর বলতে পারবে
না? বাস্তবতা হলো,এ ধরনের প্রস্তাব মেনে নেয়া হলে
আর্থিক খাতের বিদ্যমান অনিয়ম ও দুর্নীতি লাগাম ছাড়িয়ে যাবে (অবশ্য এখনও কোনো লাগাম
আছে কি না সন্দেহ এবং তার খেসারত দিতে হবে রাষ্ট্রকে।
ব্যাংক খাতে অনিয়ম বন্ধ
না করে গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপের এই বুদ্ধি যার বা যাদের মাথা থেকে এলো,
তারা যে লুটেরা এবং দেশের শত্রু, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ না করাই ভালো। সমস্যা হলো,
আমরা এখন অনিয়ম দেখতে দেখতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, কোনো কিছুই আর গায়ে লাগে
না। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় পর্যন্ত যে
মধ্যবিত্তে শ্রেণির উচ্চস্বর ছিল, সেটি এখন এতটাই তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে যে, দেশে
মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে বলেই আর ঠাওর হয় না। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই
ধনীদের দাপট এতটাই বেড়েছে যে, এখন টাকাই কথা বলে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা
থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা যা বলবেন, তার বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের
ভাবনা বা সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নেয়ার মুরদও বোধ করি সরকারের ক্রমেই কমে আসছে।
না হলে ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, এমন বিস্ময়কর আবদারের
পরও এ নিয়ে রাষ্ট্রের তরফে সরাসরি কিছু তো বলা হয়ই না, বরং অর্থমন্ত্রী বলেন, এ
নিয়ে আগামী বাজেট আলোচনায় কথা হবে।
১. নেতিবাচক সংবাদের সংজ্ঞা বা মানদণ্ড কী এবং এটা কে ঠিক করবে?
২. ব্যাংকের নেতিবাচক
সংবাদ বন্ধে ফিন্যান্সিয়াল ইনফরমেশন আইনের আওতায় যদি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের
প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রেস কাউন্সিল থাকার
দরকার কী?
৩. ব্যাংকিং খাতের
অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশ করলে যদি সংশ্লিষ্টদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং
মানুষের আস্থা কমে, তাহলে বছরের পর বছর এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হতে
থাকবে এবং জনগণের পয়সার শ্রাদ্ধ হবে, সেগুলো মানুষ জানবে কী করে?
৪. ধরা যাক এবিবির এই
দাবি সরকার মেনে নিলো এবং একটি পরিপত্র জারি করলো যে, ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে কোনো
নেতিবাচক খবর প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন অনিয়মত দুর্নীতির খবর
প্রকাশ ও প্রচার হতে থাকলো, তখন কি ওইসব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে?
৫. গণমাধ্যমকে বলা হয়
গণতন্ত্রের ওয়াচডগ। অর্থাৎ তারা সবকিছু গভীরভাবে পযবেক্ষণ করবে এবং যেখানেই অনিয়ম
ও দুর্নীতির গন্ধ পাবে সেখানেই অনুসন্ধান চালিয়ে রিপোর্ট করবে। কিন্তু এবিবির
আবদার মেনে নিলে গণমাধ্যমের ওয়াচডগ থেকে ওয়াচ শব্দটিই যদি খারিজ হয়ে যায়, তাহলে
বাকি থাকে কী?
৬. অনুসন্ধানী
সাংবাদিকতরা একটা কমন সূত্র হচ্ছে ‘ফলো
দ্য মানি’। অর্থাৎ যেখানে টাকা
সেখানেই দুর্নীতি ও অনিময় থাকার আশঙ্কা আছে। ফলে সারা পৃথিবীতেই বড় বড় সব
অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয়ে থাকে এই আর্থিক বিষয়ে। এখন যদি বলা হয় যে, আর্থিক খাতের
নেতিবাক খবর প্রকাশ করা যাবে না, তাহলে এটি কি সামগ্রিকভাবে অনুসন্ধানী
সাংবাদিকতার দরজাই বন্ধ করে দেবে না? অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ হলে কার লাভ তা
কি দেশের মানুষ জানে না?
৭. দেশটা কি ক্রমশই
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বেহাৎ হয়ে বড়লোকের কব্জায় চলে যাবে?
৮. এবিবির এই দাবি মেনে নেয়া হলে তখন কি পুলিশ বাহিনী থেকেও এই দাবি
উঠবে না যে, তাদের ঘুষ খাওয়া, অনিয়ম-দুর্নীতি, হেফাজত বা রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনে মানুষ
হত্যা, কথিত ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর খবর প্রচার করা যাবে না? প্রশাসনের কর্মকর্তারাও কি একই দাবি তুলবেন না? জনগণের ভোটে
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও কি এ কথা বলার সুযোগ পাবেন না যে, জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত
করেছে, অতএব তাদের চুরি-চামারি বা অন্যায়ের খবর লেখা যাবে না? এভাবে সব বিভাগের লোকেরা
যদি নিজেদের কথিত সম্মান ও ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে
দাবি তুলতে থাকেন এবং গণমাধ্যমকে গণশত্রুতে পরিণত করেন, তার পরিণতি কী হবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সময় হয়েছে। এবং আমরা সংসদের আগামী বাজেট অধিবেশন পর্যন্ত নিশ্চয়ই অপেক্ষা
করব যে, সেখানে এবিবির ওই আবদার নিয়ে জনগণের প্রতিনিধিরা কী বলেন এবং আখেরে কী সিদ্ধান্ত
হয়…।

No comments:
Post a Comment