Monday, February 26, 2018

রাজনীতিকের পদত্যাগ ও অবসর

আমীন আল রশীদ
আমাদের রাজনীতিকরা অবসরে যান না। যত সমালোচনাই থাকুকতারা মন্ত্রিত্বও ছাড়েন না। অথচ প্রতিবেশী ভারতেই অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে মন্ত্রীদের পদত্যাগের রেওয়াজ আছে। ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে পরিচিত পাকিস্তানে খোদ প্রধানমন্ত্রীরও পদত্যাগের উদাহরণ আছে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকরা মনে করেনআজীবন পদ ও পদবি ধরে রাখা তাদের অধিকার। দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের ব্যর্থতা তারা মানতে নারাজ।

তবে এই বাস্তবতার মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন যেআগামী ডিসেম্বরেই তিনি অবসরে যাবেন। আগামী ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। অবসরে গেলে হয়তো সেই নির্বাচনে তার অংশ নেয়া হবে না। যদিও বিভিন্ন সময়ে তিনি বলেছেন যেশেখ হাসিনা চাইলে তিনি আবারও নির্বাচন করবেন। জানানতিনি আগামী নির্বাচন করবেন কি নাএপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর জবাব দেবেন। এই বর্ষিয়ান রাজনীতিক বলেনজীবনে একটা সময় আসেতখন অবসরে যাওয়াই আমাদের জন্য ভালো। অবসরে যেভাবে থাকা যায়সেভাবেই থাকা উচিত।
যদিও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত ধ্বংসের প্রসঙ্গ টেনে অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেনডিসেম্বর পর্যন্ত কেন রক্তক্ষরণ কন্টিনিউ করবেনআজকে এখনই পদত্যাগ করুন। মানুষকে বাঁচানজাতিকে বাঁচানদেশকে বাঁচান।  ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা এই বিরোধী দলীয় সদস্য।
অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগে প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাজের সমালোচনা করে তাঁদের নিরাপদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। তার জবাবে অর্থমন্ত্রী আগামী ডিসেম্বরে অবসরে যাওয়ার কথা জানান। সেইসাথে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকেও অবসরে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে বি. চৌধুরী বলেনযেদিন আমি দেখবো আমার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষের কোনও ক্ষতি হয়েছে সেদিন আমি নির্দ্বিধায় অবসর গ্রহণ করবো। প্রসঙ্গতবিএনপির আমলে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন অথবা করতে বাধ্য হয়েছিলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই এই ইস্যুতে প্রধান দুই দলের নেতারা পরস্পরককে আক্রমণে মুখর। ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেনরাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বিশ্রাম নেওয়ার সময় চলে এসেছে। কারণতাঁর কথাবার্তার মধ্যে অসংলগ্নতা দেখা যাচ্ছে।
এর আগে ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে আদালত অবমাননার দায়ে সাজা দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু তারপরও তারা পদত্যাগ করেননি। বরং এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। সাংবিধানিকভাবে পদত্যাগে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও আদালতের দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরে নৈতিক কারণেই তাদের পদত্যাগ করা উচিত ছিল বলে মনে করা হয়।
ওই সময়ে দেশের একটি প্রভাবশালী সংবাদপত্র জনমত জরিপে প্রশ্ন রেখেছিলসর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হকের শপথ ভঙ্গ হওয়ার কথা উঠে আসায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে তাঁদের মন্ত্রিত্ব ছাড়া উচিত বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। আপনি কি তাঁর সঙ্গে একমতদেখা যায়জরিপে অংশ নেওয়া ৮৯ শতাংশ মানুষই মনে করেনদুই মন্ত্রীর সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো,এত বড় ঘটনার পরও ওই দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি। বরং যে প্রধান বিচারপতির আমলে তারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেনসেই এস কে সিনহাকেই সরে যেতে হয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থায় নানা নৈরাজ্যের কারণে বহুদিন ধরেই সমালোচিত এবং বিতর্কিত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বিভিন্ন ফোরাম থেকেই তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে। কিন্তু তিনি সাংবাদিকদের পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন যেতার পদত্যাগ করার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি।
এর আগেও লঞ্চডুবিতে শত শত মানুষের প্রাণহানির পরেও কখনও কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগ তো দূরে থাকঅন্তত নিজের অপরাধ বা দায় স্বীকারও তারা করেননি। উপরন্তু নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ২০ হাজার টাকা বা একটি ছাগল দিয়ে বাহবা নিয়েছেন। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করেননি।
বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা অবশ্য পদত্যাগ করেছেন। জিয়া পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাবেক কূটনীতিক শমশের মবিন চৌধুরী ২০১৬ সালে দলের কাউন্সিলের আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজনীতি থেকে অবসরে যান। এরপর থেকেই তিনি রাজনীতিতে একেবারেই নিরুচ্চার। খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের পরও সেই নিরবতা ভাঙেননি। সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেনআমি দলের ভেতরে রাজনৈতিক কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে চাই না।
আমরা পাকিস্তানকে অকার্যকর রাষ্ট্র বলতে পছন্দ করি। অথচ সেখানেই ২০১২ সালে আদালত অবমাননার দায়ে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে ৩০ সেকেন্ডের প্রতীকী সাজা দিয়েছিলেন এবং একই সঙ্গে তাঁর পদটিও শূন্য ঘোষণা করেন। অর্থাৎ কোনো আর্থিক জরিমানা বা কারাদণ্ড না দেওয়া হলেওবিচার বিভাগের ভাবমূর্তির স্বার্থে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দেন পাকিস্তানের আদালত। এরপর গত বছরের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ আদালতে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে দেন নওয়াজ শরিফ।
আওয়ামী লীগ নেতা নূহ-উল আলম লেনিন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেনরাজনীতিবিদদের কোনো বয়সসীমা থাকা উচিত নয়। তারা তো প্রতিনিধি। জনগণের সেবক। এটা সব ধর্মেই আছে আর যে রাজনীতি করে সে তো রাজা। রাজাদের কেন অবসরের নিয়ম থাকতে হবেচীনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেনআমার জানামতেসারা পৃথিবীর কোথাও এটা মানা হয় না। শুধু চীনের একটা পার্টি ৬৪ বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করেছে মনে হয়। এছাড়া আর কেউ করেনি। বাংলাদেশে তো এই নিয়ম নাই। বামপন্থি বলেন আর ডানপন্থি বলেনকেউ এই নিয়ম করেনিমানেও না।
তবে কেউ মানুক আর না মানুকযখন কোনো মন্ত্রী বা রাজনীতিকের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের পারসেপশন খারাপ হয়যখন আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন––তখন নৈতিক কারণেই তার আর ওই পদে থাকা উচিত নয়। তাছাড়া সবারই একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে অবসরে চলে যাওয়াই ভালো। না হলে নতুন নেতৃত্ব বিকশিত হয় না। একজন ব্যক্তি কত বছর একটি চেয়ার ধরে রাখবেনসুকান্তর ভাষায় নতুন শিশু এলে তার জন্য জায়গা তো ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলোআমাদের রাজনীতিবিদরা পরিবারের বাইরে কাউকে নিজেদের উত্তরসূরি ভাবেন না বা সেই সুযোগও দেন না। ফলে মৃত্যুর আগ পরযন্ত তারা অবসরে যান না বা পদত্যাগ করেন না। আবার তাদের মৃত্যুর পরে সেই জায়গাটি মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো তাদের উত্তর সূরিরাই দখল করেন। ফলে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বৃত্ত থেকেও আমাদের রাজনীতি বের হতে পারে না।

No comments:

Post a Comment