আমীন আল রশীদ
হাইপোথেটিক্যালি ধরে নেয়া যাক খালেদা জিয়াকে লম্বা সময়ের জন্য জেলে থাকতে হবে অথবা জামিনে বের হবার পরে চিকিৎসার জন্য বিদেশে। তাহলে এই সময়ে বিএনপি পরিচালিত হবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের নির্দেশে ও নির্দেশনায়। এরইমধ্যে দলের তরফে জানানো হয়েছে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এখন থেকে তারেক রহমানই চেয়ারপার্সন। কথা হচ্ছে তার নেতৃত্বে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই দলটি কতদূর যাবে বা যেতে পারবে কিংবা দেশের রাজনীততে তিনি নতুন কী যুক্ত করবেন?
হাইপোথেটিক্যালি ধরে নেয়া যাক খালেদা জিয়াকে লম্বা সময়ের জন্য জেলে থাকতে হবে অথবা জামিনে বের হবার পরে চিকিৎসার জন্য বিদেশে। তাহলে এই সময়ে বিএনপি পরিচালিত হবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের নির্দেশে ও নির্দেশনায়। এরইমধ্যে দলের তরফে জানানো হয়েছে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এখন থেকে তারেক রহমানই চেয়ারপার্সন। কথা হচ্ছে তার নেতৃত্বে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই দলটি কতদূর যাবে বা যেতে পারবে কিংবা দেশের রাজনীততে তিনি নতুন কী যুক্ত করবেন?
মনো রাখা দরকার, তিনিও তার মায়ের সঙ্গে দুর্নীতির একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এবং তাকে দেয়া হয়েছে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায়ও তিনি আসামি। ওই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তার আরও বড় সাজা হবে। তার মানে ক্ষমতার পালাবদল না হওয়া পর্যন্ত তারেক রহমানের পক্ষে দেশে আসা অসম্ভব। কারণ এলেই তিনি গ্রেপ্তার হবেন। তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য তার দল যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না, তা খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার ঘটনায় প্রমাণিত। সেক্ষেত্রে লন্ডন থেকে ফোনে বা ইন্টারনেটে নির্দেশনা দিয়ে দলকে তিনি কতটা গতিশীর রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
খালেদা জিয়ার যে ব্যক্তি ইমেজ সে তুলনায় তারেক।রহমানের ভাবমূর্তি যথেষ্ট খারাপ। দলের ভেতরেই তাকে নিয়ে সিনিয়র নেতাদের একটা বড় অংশের অস্বস্তি আছে বলে শোনা যায়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আরমগীরের মতো সজ্জন এবং নিরেট পলিটিশিয়ানকেও দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করে রাখা হয়েছিল তিনি তারেক বলয়ের লোক নন বলে--এমন কথাও রাজনীতির মাঠে চালু আছে।
বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে কেবল ছাত্রদল ও যুবদলের একটা অংশ এবং মূল বিএনপির একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল তারেকপন্থি বা তার অনুসারী বলে জানা যায়। আরও স্পষ্ট করে বললে দলের উগ্র অংশটি মূলত তারেক রহমানকে দলের কান্ডারি ভাবেন। কিন্তু বৃহৎ অংশই মনে করেন, তার হাতে দল নিরাপদ নয়। এর কিছু যৌক্তক কারণও আছে।
এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার মাস্টার মাইন্ড তারেক রহমান। ওই হামলার পরিকল্পনা যে হাওয়া ভবন থেকেই করা হয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। যদিও এটির বিচার চলছে এবং রায় ঘোষণার পরে প্রকৃত অপরাধী কে তা জানা যাবে।
প্রতিপক্ষ দলের নেত্রীকে গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিতে হবে এই আইডিয়ার চেয়ে দুর্নীতির মামলায় জেলে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে দলকে নেতৃত্বশূন্য এবং পঙ্গু করে দেয়া যে বেটার পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি, সেটি বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ অনেক ভালো বোঝে এবং তারেক রহমানকে দলের চেয়ারপার্সন ঘোষণার পর বিএনপি সম্ভবত সেই ক্ষয়ের দিকেই যাবে।
তারেক রহমানের রাজনীতিতে আবির্ভাব কাঙ্ক্ষিতই ছিল এবং তিনি শুরুটাও করেছিলেন তার বাবার পথ ধরে পথেঘাটে হেঁটে হেঁটে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। কিন্তু ক্রমশই ক্ষমতার বৃত্তে বন্দি হয়ে তিনি তার সেই মাটিলগ্নতাকে জলাঞ্জলি দেয়া শুরু করেন এবং তার বিরুদ্ধে বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে। শুধু তাই নয়, ওয়ান ইলেভেনের পরে দেশ ছেড়ে লন্ডনে মোটামুটি স্থায়ী হবার পরে তিনি বিস্ময়কর ও ভয়ঙ্কর পদ্ধতিতে ইতিহাস চর্চায় ব্রত হন এবং জাতির জনকের বিষোদ্গার শুরু করেন। তিনি এটি ভুলে যান যে, এই মানুষটির (বঙ্গবন্ধু) জন্ম না হলে তারেক রহমানকে হয়তো এখনও পাকিস্তানের নাগরিক হয়েই থাকতে হত। রাজনীতির এত এত বিষয় থাকতে তিনি বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার পদ্ধতিটা বেছে নিলেন কারণ তিনি জানেন এটি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। কিন্তু মি. রহমান এটি ভুলে গেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শুধু আওয়ামী লীগের নয়, দলমুক্ত কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে। সুতরাং তারেক রহমান যখন বঙ্গবন্ধুকে ছোট করেন, সেটি যে আখেরে তার নিজের পায়েই কুড়াল বসায় এবং সামগ্রিকভাবে তার দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে, সেটি বোঝার মতো জ্ঞান হয় তার নেই কিংবা তিনি এমন কিছু লোকের পরামর্শে চলেন যারা উগ্রবাদে বিশ্বাস করে এবং অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় করা যায়--এই ভুল তত্ত্বের প্রয়োগ করেন।
অথচ তারেক রহমান যেভাবে তার রাজনীতিযাত্রা শুরু করেছিলেন, সেটি বজায় থাকলে তার মায়ের অবর্তমানে তাকেই দলের প্রধান হিসেবে দেশের মানুষ একবাক্যে গ্রহণ করতো।
প্রশ্ন উঠতে পারে মানুষের এই গ্রহণ অগ্রহণে কিছু যায় আসে কি না? হয়তো আসে না। কারণ নৌকা ধানের শীষের এতই সম্মোহনী ক্ষমতা যে, কলাগাছ দাঁড় করালেও মানুষ তাকে ভোট দেয়। যে কারণে রাজনীতিপাঠে 'ভোট টু বানানা ট্রি' প্রবাদটি প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান কে, তার কালচার কেমন, তার সম্পর্কে মানুষের ওভারঅল পারসেপশন কেমন, এগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ফলে নিজের অবর্তমানে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের উপরে বিশেষ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো যোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির উপর আস্থা না রেখে সুদূর লন্ডন থেকে দল পরিচালনার সিদ্ধান্ত দিয়ে মূলত আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের আধিপত্যই টিকিয়ে রাখলেন। কিন্তু তাতে আগামী দিনের রাজনীতির জটিল সমীকরণে বিএনপি নিজে কতটা টিকে থাকবে, সে প্রশ্ন থাকলোই।

No comments:
Post a Comment