পেশাগত কারণে অনেক বিখ্যাত, কুখ্যাত
এবং সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। কিন্তু ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ব
ইজতেমা নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনের জন্য তাবলিগ জামাতের একজন মুরুব্বির
সাক্ষাৎকার নেয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করার মতো।
বিশ্ব ইজতেমার প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত
সংগ্রহের পর গন্তব্য কাকরাইল মসজিদ। আগে থেকেই এটা জানা ছিল যে, তাবলিগের
মুরুব্বিরা সাধারণত মিডিয়ার সামনে আসেন না। কাউকে সাক্ষাৎকার দেন না। ফলে ওটা ছিল
একটা আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
বাঁশের লাঠি হাতে গেটরক্ষীর কাছে
নিজের পরিচয় দিয়ে মাওলানা জোবাযের সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই জানালে প্রহরী আমাকে
বলেন, সানগ্লাস খুলে এবং জুতা হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করুন। কারণ ‘আপনি এমন একজন ব্যক্তির সাথে দেখা
করতে চাচ্ছেন যার নামে গুণাহ মাফ হতে পারে।’ অবশেষে মাওলানা জোবায়ের সাহেবের কামরার সামনে হাজির
হই। কামরার সামনে বসা যুবকের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে আগমনের কারণ জানাই। ওই যুবক
বলেন, ‘হুজুর বিশ্রামে আছেন। জোহর বা আসর
নামাজের পরে আসুন।’
এখান থেকে আরেক মুরুব্বির (নাম মনে
নেই) কাছে যাই। তিনি সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এখানে ব্যর্থ
হয়ে আরেকজনের কাছে গিয়ে দেখা যায় তিনি ব্যাগ গোছাচ্ছেন। কোথাও যাবেন। তিনি
আরেকজনের নাম বলে তার কাছে যেতে পরামর্শ দিলেন। এভাবে করে করে অবশেষে আমি ঠিকই
একজন মুরুব্বির কাছে পৌঁছাতে সমর্থ হই এবং তিনি আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে সম্মত হন।
শর্ত হলো, তাঁর নাম গোপন রাখতে হবে। তাঁর ভাষায়,‘আমরা মশহুর (বিখ্যাত) হতে চাই না,
মকবুল (আল্লাহর কাছে গৃহীত) হতে চাই।’
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি তাবলিগের
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদির পাশাপাশি তাবলিগওয়ালাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের
ভালো-মন্দ ধারণার নানা বিষয় নিয়ে বেশ খোলামেলা কথা বলেন। যেটি যায়যায়দিনে ২০০৭
সালের ২ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয়। তাঁকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, জাতির অর্থনৈতিক
স্বনির্ভরতা অর্জনে ুআপনাদের কোনো ভূমিকা নেই। আপনার পরিবার-পরিজন ফেলে দিনের পর
দিন এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ান, এর কী ব্যাখ্যা আছে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ঈমান মজবুত
হলে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নিয়ে ভাবতে হবে না। যার ভেতরে আখেরাতের চিন্তা
প্রবল,তার মধ্যে দুনিয়াবি পেরেশানি কাজ করে না।
ওই মুরুব্বিকে আরেকটা প্রশ্ন
করেছিলাম, দেশের রাজনীতি নিয়েও (তখন ওয়ান ইলেভেনের সরকার) কোনো কথা বলেন না। জাতির
কোনো বড় সংকটে চুপ থাকেন। অথচ আপনারা একটা বিশাল শক্তি। জবাবে তিনি বলেছিলেন,
আমাদের জানাশোনার কমতি আছে। আর সব বিষয় নিয়ে সবার নাক না গলানোই কি ভালো
নয়?
(২)
তাবলিগওয়ালাদের সম্পর্কে ভালো-মন্দ
দুটি ধারণাই প্রচলিত আছে। তা সত্ত্বেও এতদিন তাদের সম্পর্কে যে বিষয়টি নিয়ে কোনো
বিতর্ক ছিল না তা হলো, তারা শান্তিকামী। কখনো কোনো বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্য, আন্দোলন,
ফতোয়া ইত্যাদি নিয়ে তাদের উচ্চকণ্ঠ ছিল না। নিজেদের গণ্ডির ভেতরে তারা নিজেদের মতো
করে ধর্মকর্মের চর্চা করতেন। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের মাওলানা সাদের ইজতেমায়
অংশগ্রহণ ঠেকাতে তাবলিগ জামাতের একটি অংশ (কওমি মাদ্রাসাও সেখানে ছিল) রাজধানীর
বিমানবন্দর এলাকায় বিক্ষোভের নামে যেভাবে পুরো এলাকার রাস্তঘাট অচল করে দিয়েছিলেন,
সেটি অভূতপূর্ব। মানুষের দুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাদের এই বিক্ষোভ অভ্যাহত
থাকে বৃহস্পতিবারও। এদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেদুপক্ষের বৈঠকের পর
মাওলানা সাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় যে, তিনি এবারের ইজতেমায় অংশ নেবেন না এবং
সুবিধাজনক সময়ে ভারতে ফিরে যাবেন।
মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে কেন এই
বিক্ষোভ, তা নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু রিপোর্ট
প্রকাশিত হয়েছে। তার সত্যমিথ্যা যাচাই করা কঠিন। কারণ তাবলিগ জামাতের পুরো
কাজকর্মই বেশ গোপনীয়তার সাথে করা হয়। তারা কোনো বিষয়ই গণমাধ্যমের সাথে শেয়ার করে
না বা করার প্রয়োজনবোধ করে না। তবে কারণ যাই হোক,তাবলিগ জামাতের ভেতরেও যে ‘রাজনীতি’ ঢুকে
গেছে, তা বোঝা যাচ্ছে।
তাবলিগ জামাতের কাজকর্ম নিয়ে কিছু
প্রশ্ন থাকলেও, বিশেষ করে পরিবার-পরিজন ও কাজকর্ম ফেলে দিনের পর দিন বাইরে থাকার
সমালোচনা সত্ত্বেও এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর আয়োজনে টঙ্গীর তুরাগ তীরে অর্ধ শতাব্দী ধরে
যে বিশাল গণজমায়েত (বিশ্ব ইজতেমা) হয় এবং যেটি হজের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম
সম্মিলন, সেখানের আখেরি মোনাজাতে অংশ নেয়ার দৃশ্য অভূতপূর্ব। লক্ষ লক্ষ মানুষ সারা
দেশ থেকে ছুটে আসেন। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা এই মোনাজাতে অংশ
নেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াও নিজেদের বাসভবনে বসে এই মোনাজাতে অংশ নেন এবং সেটি
টেলিভিশনগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। সব মিলিয়ে বিশ্ব ইজতেমার একটা সামাজিক ও
রাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে।
(৩)
বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় ধর্ম বরাবরই
একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ এবং ইসলামকে
রাষ্ট্রধর্মের সাংবিধাকি স্বীকৃতি আবার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল রাখা নিয়ে সমালোচনা
যতই থাকুক, ধর্ম যে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনচর্চায় বিবিধরূপে প্রভাবক হিসেবে কাজ
করে, সে বিষয়ে বিতর্ক কম। সে কারণেই যখন আমরা দেখি যে, তাবলিগ জামাতের মতো একটি
অরাজনৈতিক ও শান্তিকামী ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকেরাও রাস্তা অচল করে দিয়ে মাওলানা
সাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়, তখন কয়েকটা প্রশ্ন আমাদের মনে উঁকি দেয়।
১. মাওলানা সাদ তাবলিগের অনেক বড়
মুরুব্বি। অনেক বছর ধরেই তিনি বিশ্ব ইজতেমায় বয়ান করেন। হঠাৎ করে তিনি কী এমন
বললেন যে একটা অংশ তার বিরুদ্ধে চলে গেলো?
২. তাবলিগে চেইন অব কমান্ড এতই
প্রবল যে, ছোট ছোট গ্রুপেও তারা যখন রাস্তায় হাঁটেন, সেখানেও সেনাবাহিনীর মতো
সুশৃঙ্খল লাইন থাকে। মুরুব্বিরা যা বলেন, সেটিকে তারা আপ্তবাক্য বলে মানেন। তার
মানে মাওলানা সাদ যা বলেছেন সেটি কেন একটি অংশ মানতে পারছেন না? তাহলে কি তাবলিগের
দর্শনে চিড় ধরেছে কিংবা এখানে মতবিরোধ প্রবল হয়ে উঠেছে?
৩. সারা বিশ্ব থেকেই বাংলাদেশের এই
ইজতেমায় লোকজন আসেন। ফলে সাম্প্রতিক এই বিরোধ ভবিষ্যতে ইজতেমায় কী প্রভাব ফেলবে
এবং বিশ্ববাসীর সামনে তাবলিগ জামাতকে নতুন করে উপস্থাপন করবে কি না?
৪. ইসলামের ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর
মধ্যে মতবিরোধ ঐতিহাসিক কাল থেকেই চলে আসছে। সেই পার্থক্যের মূলে বস্তুত দর্শন।
তাবলিগ জামাতের সাম্প্রতিক এই বিরোধের পেছনে কি দর্শন নাকি অন্য কোনো কারণও দায়ী? বিশেষ
করে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী বিশেষ করে যারা বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত হয়েছে, তাদের
সঙ্গে কি তাবলিগের কোনো কারণে বিরোধ তৈরি হয়েছে?
৫. ধর্ম মানুষের শান্তির জন্য।
মানুষ যাতে বিপথে না যায়, একটা নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে থাকে, সেজন্যই তো ধর্মের ‘আবিষ্কার’।
কিন্তু যখন এই ধর্ম নিয়েই নানান ফেরকা তৈরি হয়, মারামারি কাটাকাটি হয়, সেটি
শান্তিকামী মানুষের মনে ধর্মের খারাপ দিকটি উন্মোচিত করে। তাবলিগ জামাতের
সাম্প্রতিক এই সংকটের পেছনে মাওলানা সাদের যে কিছু কট্টর বয়ান ও নসিহতকে দায়ী করা
হচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে ইসলামকে পশ্চাতপদ ধর্ম হিসেবে প্রমাণের যে প্রচেষ্টা রয়েছে,
সেই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই কারা করছে,কোন তরিকায় করছে এবং এর পরিণতি কী––সেদিকেও নজর রাখা দরকার।
আমীন আল রশীদ

No comments:
Post a Comment