Tuesday, January 2, 2018

খাদ্য আমদানির বিপদ

আমীন আল রশীদ
ভারত থেকে গরুর মাংস আমদানির সংবাদটি উদ্বেগ তৈরি করেছে দেশীয় ডেইরি শিল্পের সাথে জড়িতদের। তারা মনে করেন, ভারত থেকে গরুর হিমায়িত মাংস আমদানির এই উদ্যোগ দেশীয় উদ্যোক্তাদের ক্ষতির কারণ হবে। যদিও সরকারের দাবি, গরুর মাংসের দাম কামতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে খাদ্য আমদানির বিপদ নিয়ে কয়েকটা প্রশ্নের অবতারণা করা যায়। সেইসাথে বছরের পর বছর অদূরদর্শী নীতি এবং একশ্রেণির লুটেরাকে আঙুল ফুলে কলাগাছ বানানোর সুযোগ করে দিতে দেশের কৃষিকে কী ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে––সেই প্রসঙ্গেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

বাস্তবতা হলো, গরুর মাংস রপ্তানি করা ভারতের জন্য যতটা জরুরি, বাংলাদেশের জন্য আমদানি ততটাই নিরর্থক। ভারতের পথেঘাটে গরু হাঁটে। সেখানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় কারণে গরুর মাংস খায় না এবং অনেক জায়গায় গরু জবাই করাও নিষিদ্ধ। সুতরাং গরুর মাংস রপ্তানি করাটা তাদের দেশের অর্থনীতি এবং পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন।
প্রাণিসম্পদ অধিপ্তরের তথ্য (লাইভস্টক ইকোনমি অ্যাট এ গ্লান্স) অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মাংসের চাহিদা বছরে ৭১ দশমিক ৩৫ লাখ মেট্রিক টন (মাথাপিছু দৈনিক ১২০ গ্রাম হিসেবে)। আর এই চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ৭১.৫৪ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় মাংসের উৎপাদন বেশি।সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছরই দেশে গবাদী পশুর চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে উপাদনও বাড়ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে গরুর সংখ্যা সংখ্যা ছিল ২২৯ লাখ। এরপর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে  ২২৯.৭৬ লাখ, ২০০৯-১০ অর্থবছরে  ২৩০.৫১ লাখ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৩১.২১ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৩১.৯৫ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে  ২৩৩.৪১ লাখ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৩৪.৮৮ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে  ২৩৬.৩৬ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে  ২৩৬.৮৬ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৩৭.৮৫ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩৯.৩৫ লাখ। একইভাবে মহিষ, ভেড়া ও ছাগলের উৎপাদনও প্রতিবছর বাড়ছে। তার মানে চাহিদার বিপরীতে উপাদন যথেষ্ট হওয়ার পরও কেন গরুর মাংস আমদানি করতে হবে? কেন প্রতি বছর কোরবানির ঈদের সময় ভারত থেকে গরু না এলে দেশীয় গরুর দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়?
বর্তমানে ঢাকার বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৫০০ টাকা।কিন্তু খোদ ব্যবসায়ীরাই বলে থাকেন যে, তারা তিন থেকে সাড়ে তিনশো টাকা কেজিতেও মানুষকে গরুর মাংস খাওয়াতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন কেবল চাঁদাবাজি বন্ধ করা। সম্প্রতি রাজধানীতে ধর্মঘটে গিয়েছিলেন মাংস ব্যবসায়ীরা । তখন তাদের নেতারাও এ কথা বলেছিলেন যে, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি না থাকলে এবং বৈধভাবে গরু আমদানির সুযোগ থাকলে তারা গরুর মাংস ৩০০ টাকার নিচে বিক্রি করতে পারবেন। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একজন খামারী তার গরু লালন-পালন করে বিক্রি উপযোগী হবার পরে বাজারে নিয়ে বিক্রির পযায় থেকে শুরু করে খুচরা দোকানীর কাছে অর্থাৎ যিনি মাংস বিক্রি করেন, প্রতিটি ধাপেই হাটের ইজারাদার, স্থানীয় মাস্তান, বাজারের চাঁদাবাদ এবং অনেক সময় পুলিশকেও পয়সা দিতে হয়।
দেখা যাচ্ছে, চাহিদার বিপরীতে জোগান বেশি থাকলে দাম কমবে, অর্থনীতির এই ক্ল্যাসিক থিওরি গরুর মাংসের বাজারে কাজ করছে না। বরং এটি সরাসরি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর সুশাসনের সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে নিবীড় সম্পর্ক, তা সকলেই স্বীকার করেন। সুতরাং চাঁদাবাজি ও বাজারে মাস্তানি বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিকতা এবং সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দাম কমানোর অজুহাতে গরুর মাংস আমদানির কোনো প্রয়োজন হয় না।
সরাসরি মাংস আমদানির কিছু বিপদও আছে। কারণ যে মাংস ভারত থেকে আমদানি করা হবে, সেটি হালাল উপায়ে জবাই করা হয়েছে কি না, কোনো জীবানু সেই মাংসে আছে কি না, ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের গরিষ্ঠ মুসলমান ক্রেতাদের উদ্বেগ থেকেই যাবে। ফলে আমদানিকৃত মাংস খুব বেশি জনপ্রিয় হবে বলে মনে হয় না।
২.
শিল্পায়ন তথা গ্রাম পর্যায়ে কল-কারখানা এবং আবাসন ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে কৃষিজমি। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের যে দেশে ১৬/১৭ কোটি মানুষের বসবাস এবং যেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই, উপরন্তু মাঝেমধ্যে উটকো ঝামেলা হিসেবে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে হয়, তখন কৃষিজমি কমতে থাকলে একসময় বাংলাদেশের সব খাদ্যপণ্যই আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়বে কি না, সেই উদ্বেগও রয়েছে।
আমরা বলি যে, মধ্যম আয়ের এবং উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হতেহলে আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু কী সেই উৎপাদন? ধান-সবজি-মাছ? না। এইসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে খুব বেশি লাভ হয় না। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরাও দ্রুত শিল্পায়নের দিকে যেতে চাই। পাড়ায়-মহল্লায় গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। পরিবেশের বারোটা বাজছে, নদী দূষিত হচ্ছে,মাছ ভরে ভেসে উঠছে––সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ কম। আমরা রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে চাই। এই রপ্তানির সঙ্গে আছে কোটি টাকার আবাসন ব্যবসার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে গেলে রাস্তার দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত কৃষিজমিতে হাজার হাজার সাইনবোর্ড। অমুক রিয়েল স্টেট, তমুক রিয়েল স্টেট।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব জমি প্রাথমিকভাবে লিজ নিয়ে সাইনবোর্ড টানায় কোম্পানিগুলো। তারপর প্লট করে বিক্রি করে। অনেকে প্লট বুঝে পায়, অনেকে বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ আবাসন ব্যবসাকে ঘিরে ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসন এবং  স্থানীয় প্রভাবশালীদের যে বিশাল চক্র গড়ে উঠেছে, তাতে সবচেয়ে সংকটে পড়েছে দেশের কৃষিজমি। যে হারে আবাসনপ্রকল্প গড়ে উঠছে তাতে বছর বিশেষ পরে দেশের কত শতাংশ কৃষিজমি আর অবশিষ্ট থাকবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
বাংলাদেশের জমিকে বলা হয় সৃষ্টিকর্তার অপার দান। এমন উর্বর জমি আছে বলেই এই ছোট্ট ভূখণ্ডেও ১৬/১৭ কোটি মানুষ খেয়েপরে বেঁচে আছে। কিন্তু তারপরও অনেকে এমনও বলেন যে, যদি এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে যে পরিমাণ আয় হবে, সেই জমিতে কোনো কারখানা গড়ে তুলে সেখান থেকে তার কয়েকশো গুণ বেশি অর্থ আয় করা যায়, তাহলে ধান চাষের প্রয়োজন কী? তখন পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, যদি এভাবে কল-কারখানার নামে একসময় সব কৃষিজমিই বেহাত হয়ে যায়, তখন মানুষ খাবে কী? তার জবাবে তারা বলেন, প্রয়োজনে খাদ্যপণ্যও আমদানি করা হবে। কারণ তখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।
যুক্তির বিচারে হয়তো এটি ফেলনা নয়। কিন্তু এমন উর্বর জমি একবার বেহাত হয়ে গেলে তা আর ফিরে আসবে না। তার মানে দেশের জনসংখ্যা যখন তিরিশ কোটি হবে এবং যখন খাদ্যের চাহিদা দ্বিগুণ হবে, তখন চাল-ডাল-আটা-সবজি যদি বিদেশ থেকে আমদানি করে খেতে হয়, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমাদের স্মরণ করতে হবে কাতারের পরিস্থিতি।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই ধনী রাষ্ট্রের মোটামুটি সব খাদ্যপণ্যই আমদানি-নির্ভর। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি আরব দেশের সাথে তাদের সম্পর্কের টানাপড়েন এবং সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক যুদ্ধের কারণে সীমান্তে খাদ্যপণ্য বোঝাই সারি সারি ট্রাক আটকে দেয় সৌদি সরকার। সন্ত্রাসবাদের সহযোগিতার অভিযোগে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও সব ধরনের সড়ক, সমুদ্র ও আকাশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সৌদি আরব, বাহরাইন, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। বলাই বাহুল্য যে, এর পেছনে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন রাজনীতি।
খাদ্যপণ্যবাহী ট্রাকগুলো সীমান্তে আটকে থাকায় খাদ্য সংকটের আশংকা দেখা দেয় কাতারে। যদিও এই পরিস্থিতিতে কাতারকে সমুদ্রপথে খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয় ইরান। অন্যান্য কিছু দেশও আকাশপথে পণ্য পাঠায়। কিন্তু স্থলপথে আসা পণ্যের দামের সঙ্গে আকাশপথে পাঠানো পণ্যের দামের ফারাক তৈরি হয় আকাশ-পাতাল। এরকম পরিস্থিতি তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশের ক্ষেত্রে যদি ঘটে তাহলে সেটি দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে। সুতরাং খাদ্য পণ্য আমদানি-নির্ভর করে ফেলা বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির এবং বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। সুতরাং কৃষিজমি বাঁচানো এবং কৃষিকে আরও আধুনিক করার কোনো বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে একমত যে, বছরে যে পরিমাণ কৃষিজমি কমছে, তার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। সুতরাং উর্বর ও কৃষি উপযোগী জমিতে কোনো ধরনের অবকাঠামো এমনকি ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধের জন্যও প্রয়োজন কঠোর আইন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ। আশার সংবাদ হলো, সরকার ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে একটি আইন করতে যাচ্ছে। মন্ত্রিসভা এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছে। যেখানে বাড়িঘর বা স্থাপনা তৈরির জন্য আগাম ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদ এ ছাড়পত্র দেবে।
সুতরাং গরুর মাংস বা অন্যান্য খাদ্যপণ্য আমদানি নয়, বরং দেশেই এর উৎপাদন বাড়িয়ে বরং চাহিদা মেটানোর পর রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া উচিত। বাংলাদেশ শুধু তৈরি পোশাক আর ওষুধ রপ্তানি করেই বিশ্বে শীর্ষে থাকবে তা নয়, বরং মাংস, মাছ, চাল ও সবজি রপ্তানিতেও বাংলাদেশ যাতে নেতৃত্ব দিতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।তবে সবার আগে প্রয়োজন সুশাসন। একজন ব্যবসায়ী নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারবেন; ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হবে না, হুমকি-ধামকি শুনতে হবে না––সেই নিশ্চয়তাটুকু রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।


No comments:

Post a Comment