Tuesday, October 3, 2017

৯৬ অনুচ্ছেদের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না?


আমীন আল রশীদ
একজন বিচারক অসুস্থ হয়েছেন অথবা অসুস্থ বোধ করছেন এবং তিনি আপাতত কাজ করতে সক্ষম নন বলে ছুটি নিয়েছেন––এটা ঘটনা হিসেবে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এ কারণে যে, সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্রপতির কাছে ছুটির আবেদন করেছেন। যখন প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে সংসদে এবং সংসদের বাইরে বিষোদ্গার হচ্ছে––তখন এই আকষ্মিক ছুটি কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন,রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা ছুটি বিষয়ক চিঠিতে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, তিনি ক্যান্সার ও নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। সেগুলো সম্পূর্ণ সারেনি। তাই বিশ্রামের প্রয়োজন।
২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির আবদন করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ওইদিন রাতেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞাকে দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
বাস্তবতা হলো, সংবিধানের ৯৭ অুনচ্ছেদ ‍অনুযায়ী কোনো বিচারপতি অসুস্থতার কারণে ছুটিতে যেতে চাইলে সেজন্য রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লেখা বা আবেদন জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই।৯৭ অনু্চ্ছেদে বলা আছে:প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁর দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলে রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে ক্ষেত্রমত অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধানবিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করবেন।
এখানে অসুস্থতাজনিত কারণে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লেখা বা ছুটির আবেদন জানানোর কোনো বিষয় নেই।বরং রাষ্ট্রপতি চাইলেই তাকে ছুটিতে পাঠাতে পারেন এবং সেইমতো আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক আব্দুল ওয়াহহাব মিঞাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠির প্রশ্ন আসে যদি তিনি পদত্যাগ করতে চান এবং সেটি ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিস্কার বলা আছে।সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ নয়, বরং এক মাসের ছুটিতে গেছেন। তবে আমরা জানি না, প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে আসলে কোনটা ঘটেছে, ৯৬ না ৯৭? হয়তো দ্রুতই জানা যাবে।
দ্বিতীয়ত সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র রেজিস্ট্রার জেনারেল। প্রধান বিচারপতি যদি অসুস্থতার কারণে ছুটিতে যেতে সেটি রেজিস্ট্রারের মাধ্যমেই আসবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির ছুটি চাওয়া, মঞ্জুর হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলছেন আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল। এর ব্যাখ্যা কে দেবেন?
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এবং একটি পক্ষ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায়। বিএনপি বা অন্য বিরোধী পক্ষের এ নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ থাকতেই পারে। কিন্তু এটাকে  সাধারণীকরণের সুযোগ নেই। কারণ বেশ কিছুদিন বিদেশে ছুটি কাটিয়ে কাজে যোগদানের ঠিক আগের দিন  আকষ্মিকভাবে মি. সিনহার এই ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি নানা কারণেই প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকেরই এই প্রশ্ন তোলার অধিকার রয়েছে। কেননা এর সঙ্গে দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নটি খুব সিরিয়াসভাবে জড়িত।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ড.আব্দুর রাজ্জাক একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে তিনি হয়তো একটা মানসিক চাপ অনুভব করছেন, তিনি হয়তো এটা উপলব্ধি করতে পারছেন যে তিনি ভুল করেছেন, সেই অনুশোচনা থেকে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে গেছেন।ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের এই বক্তব্যের মধ্যে পুরো বিষয়টা পরিস্কার।
তবে এই ঘটনায় প্রধান বিচারপতি নিজে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তা হয়তো ইতিহাস নির্ধারণ করবে। কেননা আগামি পয়লা ফেব্রুয়ারি তার ৬৭ বছর পূর্ণ হবে। ফলে সংবিধান অনুযায়ী ওইদিন তার পদের মেয়াদবসান হবে। সুতরাং তিনি এক মাসের ছুটি শেষে আবার কাজে ফিরবেন কি না, নাকি পয়লা ফেব্রুয়ারির আগে আরও কোনো ঘটনা ঘটবে, তা এখনই বলা মুশকিল।যদিও আইনমন্ত্রী বলেছেন, আমরা আশা করি এবং প্রার্থনা করি যে, তিনি (প্রধান বিচারপতি) এক মাস পরে আবার কাজ শুরু করবেন।
তারপরও এই ঘটনা সরকার, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করবে। দেশে এবং দেশের বাইরে নেতিবাচক বার্তা যাবে। যদি মি. সিনহা আসলেই অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়ে থাকেন, তাও এই মুহূর্তে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারণ তাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এবং খোদ সংসদ সদস্যরা তার পদত্যাগ দাবি করছেন। ফলে অনেকেই তার এই ছুটিতে যাওয়াটাকে ভদ্রোচিত বা নিরব অপসারণ বলে অভিহিত করছেন। আবার যদি প্রধান বিচারপতি সত্যি সত্যিই রাষ্ট্রপতিকে ছুটির বিষয়ে চিঠি লিখে থাকেন, সেটি কোন পরিস্থিতিতে লিখেছেন বা সিই করেছেন, তা হয়তো কোনোদিনই জান যাবে না।
মনে রাখা দরকার, বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নাকি সংসদের হাতে থাকবে––সেই প্রশ্ন সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ যে পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন, সেখানে দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং একটি রাষ্ট্র গঠনের চ্যালেঞ্জসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ  দিয়েছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তারপরেই তার বিষোদ্গার শুরু হয়।
তবে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ দল, যাদের তেৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের আমলে এজন প্রধান বিচারপতির ছুটি ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে যেসব বিতর্ক হয়েছে––তা খুবই দুঃখজনক এবং দেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এটি একটি ব্যাড ইন্টট্যান্স হয়েই থাকবে, বিচার বিভাগে যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারি।
রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা যে নির্বাহী বিভাগের হাতেই এবং কাগজে-কলমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন বলা হলেও এটা যে আসলে সেপারেশন বা নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হওয়া ছাড়া কিছু নয়;বরং সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদ (এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক বিচারকার্যে স্বাধীন থাকবেন) থেকে যে আমরা এখনও ঢের দূরে––মি.সিনহার আকষ্মিক ‍ছুটি সেই নির্মম বাস্তবতাই যেন আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দিলো।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
 


No comments:

Post a Comment